শংকর বড়ুয়া রুমি :

কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান ‘হিমছড়ি পিকনিক স্পট’ ইজারা না দিয়ে দর্শনার্থী ফি আদায়ে অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে; এতে একটি চক্র দর্শনার্থী ফি আদায়ের নামে আত্মসাত করছে সরকারি রাজস্ব।

প্রতি অর্থ-বছরে কক্সবাজার দক্ষিণ বনভিাগ দরপত্র আহবানের মাধ্যমে পর্যটন স্পটটি দর্শনার্থী ফি আদায়ে মোটা অংকের টাকায় বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্টানকে ইজারা দেয়া হত। কিন্তু ২০১৬-২০১৭ অর্থ-বছরে ইজারাপ্রাপ্ত ‘মেসার্স এনআর এন্টারপ্রাইজ’ এর চুক্তির মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই গত ১২ নভেম্বর থেকে দর্শনার্থী ফি আদায়ের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ‘ হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে’।

অন্যান্য বছর ইজারাদারের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দরপত্র আহবানসহ সংশ্লিষ্ট দাপ্তরিক কাজগুলো সম্পন্ন করা হলেও এ বছর তা অনুসরণ হয়নি। কিন্তু ইজারাপ্রাপ্ত প্রতিষ্টানের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দর্শনার্থী ফি আদায়ে খাস-কালেকশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

বিগত বছরগুলোতে হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্রটির দর্শনার্থী ফি আদায়ে দরপত্র আহবানের মাধ্যমে ইজারা দেয়া হলেও এ বছর খাস-কালেকশন আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ‘হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে’। এতে প্রতিদিন পর্যটকদের কাছ থেকে আদায় করা দর্শনার্থী ফি থেকে বনবিভাগ ৫০ ভাগ এবং বাকী অর্ধেক পায় সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি। বনবিভাগের সরাসরি তত্ত্বাবধানে হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি আদায় করছে এ দর্শনার্থী ফি। এতে অনিয়মের মাধ্যমে একটি চক্র অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব আত্মসাত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।

তবে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবছর দরপত্র আহবানের মাধ্যমে হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্রটি ইজারা দেয়া হলেও এ বছর মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে ‘হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে’ খাস-কালেকশনের মাধ্যমে দর্শনার্থী ফি আদায়ের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গত ১২ নভেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে এ নির্দেশনা পাওয়া গেছে। এরপর সংশ্লিষ্ট বনবিভাগ সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে গত ২৫ নভেম্বর থেকে দর্শনার্থী ফি আদায়ের জন্য অনুমতি প্রদান করে।

সূত্রটি জানিয়েছে, হিমছড়ি পিকনিক স্পটটি বিগত ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ৫৬ লাখ টাকায় বিচ টেলিকম, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ৭২ লাখ টাকায় মেসার্স এনআর এন্টারপ্রাইজ এবং ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে একই প্রতিষ্টানকে ১ কোটি ২১ লাখ টাকায় ইজারায় দেয়া হয়েছিল।

পর্যটন স্পটটি ইজারা নিতে ইচ্ছুক একাধিক প্রতিষ্টানের সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, গতবাবের ইজারাপ্রাপ্ত প্রতিষ্টান মেসার্স এনআর এন্টারপ্রাইজ, সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের কর্মকর্তা এবং বনবিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে এ বছর খাস-কালেকশনের মাধ্যমে হিমছড়ি পর্যটন স্পটটির দর্শনাথী ফি আদায়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে নানাভাবে সুপারিশ করেছে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ। এতে খাস-খালেকশন আদায়ের জন্য হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দায়িত্ব দেয়ার সুপারিশ ছিল। সংঘবদ্ধ চক্রটি দরপত্র আহবান বন্ধ রেখে ইজারা না দিয়ে সরাসরি দর্শনাথী ফি আদায়ের অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।

ইজারা নিতে ইচ্ছুক একাধিক প্রতিষ্টানের সংশ্লিষ্টরা জানান, গত মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে কক্সবাজারে শুরু হয়েছে ভর পর্যটন মৌসুম। বছরের অন্যান্য সময় পর্যটক আনাগোনা কম থাকলেও এসময়ে প্রতিদিন অন্তত লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে কক্সবাজারে। এসময়টাতেই পর্যটন স্পটটিতে সবচেয়ে বেশী দর্শনার্থী ফি আদায় হয়ে থাকে। সংঘবদ্ধ চক্রটি প্রতিদিনের আদায় করা মোটা অংকের দর্শনার্থী ফি শুভংকরের ফাঁকি দিয়ে আত্মসাত করতে পর্যটন স্পটটি ইজারা না দিয়ে খাস-কালেকশনের মাধ্যমে আদায়ে অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।

এসব অপচেষ্টার সঙ্গে বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, হিমছড়ি উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির কমিটির কতিপয় ব্যক্তি বিশেষ এবং গতবারের ইজারাপ্রাপ্ত প্রতিষ্টানের ব্যক্তিরা যোগসাজশপূর্বক খাস-কালেকশন আদায়ের তৎপরতার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের সদর কক্সবাজার রেঞ্জ কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ বছর হিমছড়ি পর্যটন স্পটটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে আপাতত ইজারা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১২ নভেম্বর এ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা পৌঁছেছে। এতে হিমছড়ি উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দর্শনার্থী ফি বাবদ খাস-কালেকশন আদায় করতে অনুমতি সংক্রান্ত নির্দেশনা রয়েছে।

তবে হিমছড়ি উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে খাস-কালেকশন আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।

রেঞ্জ কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ বলেন, “মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে দরপত্র আহবানের মাধ্যমে পর্যটন স্পটটি ইজারা দেয়ার সার্বিক কার্যাদি সম্পন্ন করা হবে। এর আগে পর্যন্ত হিমছড়ি উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি খাস-কালেকশনের মাধ্যমে দর্শনার্থী ফি আদায় করবে। যার ৫০ ভাগ পাবে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ এবং বাকী অর্ধেক পাবে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি।”

তবে তিনি খাস-কালেকশন আদায়ে কোন ধরণের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেন।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের প্রধান বনসংরক্ষক মো. আলী কবির বলেন, গত বছর ইজারাপ্রাপ্ত প্রতিষ্টান ‘মেসার্স এনআর এন্টারপ্রাইজ’ এর সঙ্গে ইজারাদানের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। বিষয়টি এর আগেই মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। পরে এ বছর পর্যটন স্পটটির দর্শনার্থী ফি আদায়ের জন্য গত ১২ নভেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পাওয়া যায়। এর আলোকেই গত ২৪ নভেম্বর থেকে খাস-কালেকশনের মাধ্যমে দর্শনার্থী ফি আদায় করছে হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি’।

তবে তিনিও খাস-কালেকশন আদায়ের মাধ্যমে কোন ধরণের অনিয়ম-অপব্যবস্থাপনার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে না বলে জানান।

হিমছড়ি পিকনিক স্পটের গত বছর ইজারাপ্রাপ্ত প্রতিষ্টান মেসার্স এনআর এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারি নুরুল আমিন সিকদার ভূট্টো বলেন, কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের সংশ্লিষ্টদের কাছে এ বছর দরপত্র আহবানের মাধ্যমে ইজারা না দেয়া বিষয়টি চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়ার আগেই অবহিত হয়েছি। তাই পর্যটন স্পটটি ইজারাদানে দরপত্র আহবান না করায় নতুন করে চুক্তির জন্য চেষ্টা করা হয়নি।

তবে তিনিও এ বছর খাস-কালেকশনের মাধ্যমে দর্শনার্থী ফি আদায়ের জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকার কথা স্বীকার করেন।

এদিকে দরপত্র আহবানের মাধ্যমে হিমছড়ি পর্যটন স্পটটি ইজারা না দিয়ে সরকারের মোটা অংকের রাজস্ব আত্মসাত করার অভিযোগ উঠেছে একাধিক মহলের। এতে খাস-কালেকশনের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ না করে ভর পর্যটন মৌসুমকেই বেছে নেয়া হয়েছে। যাতে করে সরকার বঞ্চিত হবে বিপুল সংখ্যক রাজস্ব থেকে।