শাহেদ মিজান, সিবিএন:
রাবেয়া বেগম। বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। কিন্তু দৈহিক অবয়বে আরো বয়স্ক মনে হয়। ভাঙা শরীর নিয়ে অনেকটা কুজো হয়ে হাঁটাচলা করেন। রামু এবং কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করেই রুটি-রুজি যোগান তিনি। আবার অনেকের কাছে পরিচিত। কারণ তিনি পরিচয় দেন তার ‘আব্বা’ হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। এই বিষয়টি লোকজন তেমন গুরুত্ব দেন না। এই কারণে তাকে মানসিক রোগী বলে মনে করেন লোকজন। এই প্রতিবেদক বিষয়টি নিয়ে জানার চেষ্টা করেছেন।

‘বঙ্গবন্ধু কন্যা’ বিষয়টি নিয়ে রাবেয়া বেগমের সাথে প্রতিবেদকের সাথে কথা হয়। আলাপচারিতায় রাবেয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা’ দাবির পক্ষে অনেক কথা তোলে ধরেন। তিনি ৩ বছর বয়স থেকে ১১ বছর পর্যন্ত ৯টি বছর বঙ্গবন্ধুর পরিবারে লালন-পালন হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা বেগম মুজিব রাবেয়াকে মেয়ে হিসেবে লালন-পালন করেছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

রাবেয়া বেগম জানান, রামু উপজেলার তেচ্ছিপুল মালিয়াপাড়ার মৃত মো. কালুর মেয়ে তিনি। তার মায়ের নাম মৃত মেহের খাতুন। তার বয়স যখন ৩ বছর বয়স তখন বঙ্গবন্ধু তাকে কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া থেকে কুড়িয়ে ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় রাবেয়া বাহারছড়ায় তার খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। ১১ বছর বয়স পর্যন্ত ৯ বছর রাবেয়া বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে ধানমন্ডির বাসভবনের ছিলেন।

রাবেয়া বেগম বলেন, ‘বাহারছড়ায় বর্তমান মহিলা মাদ্রাসার পশ্চিম পাশে আমার এক খালার বাড়ি ছিলো। সেখানে ছোটবেলায় বেড়াতে আসতাম। সেখানে বেড়াতে এলে সাগর পাড়সহ বিভিন্ন স্থানে আমরা ঘুরতাম। এভাবে একদিন বাহারছড়ায় একটি হোটেল সামনে (হোটেলের নাম বলতে পারেনি) আমি ও ওই এলাকার একটি মেয়ে খেলছিলাম। ওই হোটেলে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে বেড়াতে এসেছিলেন। সেখানে প্রথম দিন বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে আদর করেন। দ্বিতীয় দিনও আমাকে দেখে আদর করে কিছু নাস্তা দিয়েছিলেন। তৃতীয় দিনও আমি সেখানে খেলতে যাই। আব্বা (বঙ্গবন্ধু) মনে করেছিলেন আমার মা-বাবা কেউ নেই। তাই তিনি আমাকে তাদের সাথে যাবো কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম। বাহারছড়ার উকিল সালাম (উকিল সালামের বিস্তারিত পরিচয় দিতে পারেননি) আমাকে আব্বার হাতে তোলে দিয়েছিলেন।’

এর পরের ঘটনা জানিয়ে রাবেয়া বেগম জানান, কক্সবাজার থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে প্রথমে তাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যায়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ এর বাড়ি নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু ও ফজিলাতুন্নেছাকে আব্বা ও আম্মা বলে ডাকতেন রাবেয়া বেগম। বঙ্গবন্ধু রাবেয়ার বেগমের নাম রেখেছিল ‘সাগরিকা কক্সী’।

রাবেয়া বেগম বলেন, ‘প্রথম দিকে সেখানে কিছুই ভালো লাগতো না। মা-বাবা ও ভাইবোনের জন্য খুব মান কাঁদতো। বিষয়টি বুঝতে পেরে আব্বা ও আম্মা আমাকে আদর-যতœ করেন। তাঁরা দু’জন খুব আদর করতো। বুবু (শেখ হাসিনা), রেহেনা, শেখ কামাল ও শেখ জামালের সাথে এক সাথে খেলতাম। তারা চারজনই আমার বড় ছিলো। তাদের সাথে ঘুমাতাম। সবাই এক সাথে খাবার খেতাম। ঢাকা যাওয়ার পরপরই আব্বা আমাকে দামি সুন্দর জামা-কাপড় ও স্বর্ণের অলংকার কিনে দিয়েছিল।’

ধানমন্ডির পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাবেয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়িটি ছিলো তিন তলা বিল্ডিং এবং বারান্দা ছিলো পশ্চিম দুয়ারী। বারান্দায় আব্বা লোকজনের সাথে কথা বলতেন। প্রায় সময় লোকজনে ভরা থাকতো বারান্দা। আব্বা তাদের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলতেন। আব্বা বাইর থেকে এসে বাড়িতে ঢুকেই ‘সাগরিকা কক্সী’ বলে আমাকে ডাক দিতেন। আমিও ছুটে গিয়ে আব্বার কোলে উঠে যেতাম। বিকেল বেলায় বুবু হাসিনা, রেহেনা, শেখ কামাল ও শেখ জামালের সাথে ধানমন্ডি লেকের পাশে খেলতাম। সেখানে ঝাউগাছ ছিলো তখন। লেকে আমরা গোসলও করতাম। সেখানে নানা ধরণের মানুষ দেখা যেতো। সেখানে পড়ালেখাও করি আমি। এক পর্যায়ে অনেক আদর-যতœ পেয়ে আমি বাড়ির কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম।

ঢাকা থেকে চলে আসা কাহিনী সম্পর্কে রাবেয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের গ্রামের (রামু) এক জাহাজের চেরাং (ক্যাপ্টেন) ছিলো। তার নাম সোলাইমান। তিনি ধানমন্ডি এলাকায় থাকতেন। ওই সময় আমরা ধানমন্ডি লেকে গোসল করতে যাই। সেখানে চেরাং (ক্যাপ্টেন) আমাকে দেখে চিনে যায়। তিনি এসে আমার বাবা-মাকে বিষয়টি বলে। মূলত আমাকে চেরাং চিনতে পারে মুখে কালো তিলের (মুখমন্ডলের দিকে ইঙ্গিত করে) কারণে। তখন আমার বয়স ১১ বছর। এর পাঁচদিন পর বাবা, ওই চেরাং, পাড়ার সর্দার কবির মিলে আছরের আগে ধানমন্ডি পৌঁছে তারা লেকের পাশে বসে থাকে। ওই সময় সেখানে আমরা গোসল করতে আাসি। আমার বাবা আমাকে দেখে তবে তখন কিছু বলেনি। আমরা বাড়িতে চলে গেলে পরে তারা বাড়িতে যায়। তাদের নাস্তা দেয়া হয়। বাড়িতে বাবা আমাকে দেখে অঝোর ধারায় কান্না করেন। তখন আমারও কান্না চলে আসে। পরে আব্বা (বঙ্গবন্ধু) অফিস থেকে আসে। ওনি আসার পর বুবুসহ (শেখ হাসিনা) সবাই বারান্দায় আসে। বাবাকে আমাকে চিনে কিনা পরীক্ষা করেন আব্বা। পরীক্ষায় বাবা পাশ করেন। তখন আমাকে নিয়ে আসতে চাইলে আব্বা না আনতে বাবাকে অনুরোধ করেন। কিন্তু মায়ের আহাজারির কথা বললে আব্বা রাজি হন। তবে বাবাকে ওয়াদা করান বেড়িয়ে দু’সপ্তাহ পর আবার দিয়ে যাবে। অবশেষে আমাদের আসার পালা। আমাকে তুলে দেয়ার সময় আব্বা, আম্মাসহ সবাই অঝোর ধারায় কান্না করেছিলেন। আসার সময় আব্বা আমাকে টাকা, অনেক জামা দিয়ে গাড়িতে তোলে দেন।

রাবেয়া বেগম বলেন, ‘রামুতে বাড়িতে এলে মা আমাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে মূর্ছা যায়। পাড়ার অনেক লোকজন আমাকে দেখতে আসে। ততদিনে আমি অনেক বড় হয়ে যাওয়ায় অনেকে আমাকে চিনছিলো না। আমিও কাউকে চিনি না। তাই আমার কিছু ভালো লাগে না। রামুতে এসে জানলাম, সবাই মনে করেছিল আমি সাগরের ভেসে গিয়েছিলাম। তাই মা অনেক দিন সাগরের পাড়ে গিয়ে কান্না করেছিল। আব্বার সাথে ওয়াদা করা সত্ত্বেও আমাকে আর ঢাকায় দিতে যায়নি বাবা। মূলত মায়ের কারণে তা সম্ভব হয়নি। মা আমাকে যেতে দেয়নি।’

‘স্বাধীনতার দু’বছর পর বড় ভাইসহ আমি ঢাকায় যাই (৭৩’এর নির্বাচন)। এর আগেই আমার বিয়ে যায়। তখন ভোটের ধামাকা চলছে। তখন আব্বা ছিলো কুষ্টিয়ায় ভোটের কাজে। বাসায় তিনদিন থাকার পর দেশের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ায় আমাদেরকে কক্সবাজার চলে আসতে বলেন আম্মা। পরে আব্বা কক্সবাজার আসলে সার্কিট হাউসে দেখা করতে বলেন। আমরা চলে আসি।’ বলেন রাবেয়া বেগম।

রাবেয়া বেগম বলেন, ‘ভোটে আব্বা রাজা হন। রাজা হওয়ার পর আব্বা কক্সবাজার আসেন। আব্বার সাথে দেখা করার জন্য দিনের বেলায় আমরা সার্কিট হাউজে যাই। কিন্তু পুলিশের বাধার কারণে আমরা দেখা করতে পারিনি। পরে রাতে মোজ্জামেল চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সার্কিট হাউসে যাই। তখন আমাকে দেখে আব্বা অনেক দূর থেকে ‘সাগরিকা কক্সী’ বলে ডাক দেন। কাছে গেলে আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরেন। আমি আব্বাকে পেয়ে সেদিন অনেক কান্না করি। আব্বা ওই দিন আমাদেরকে রামুর বাড়ি বিক্রি করে স্বপরিবারে ঢাকায় চলে যেতে বলেন। আব্বার কথা মতো আমরা তৈরি হচ্ছি। কিন্তু প্রস্তুতি দেরি হয়ে যায়। এর মধ্যে আব্বা-আম্মাসহ সবাইকে হত্যা করার খবর পাই। সে খবর পেয়ে আমি অনেক কেঁদেছিলাম।

বিয়ে ও জীবন সংগ্রামের কাহিনী তোলে ধরে রাবেয়া জানান, স্বাধীনতার দু’বছর পর তার বিয়ে হয়। স্বামী চকরিয়ার চিরিঙ্গার স্বামী- মৃত মোক্তার আহামদ। দু’মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। ১৬ বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে স্বামী মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর ঠাঁই হয় বাপের বাড়ি রামুতে। সেখানে একটি খুপরি ঘরে পার হয় তার দিনরাত। দু’মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে নিয়ে জীবন সংগ্রামের কঠিন দুর্বিপাকে পড়ে যান রাবেয়া বেগম। ছেলের আয়ে চলবে তো দূরের কথা উল্টো নিজের ভিক্ষার টাকা দিয়ে ছেলে ও তার পরিবারকে চালাতে হয় রাবেয়া বেগমকে। তাই প্রতিদিন তাকে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নামতে হয় পথে। এভাবে নিজের ও ছেলের ভরণপোষণের চাপে হাঁপিয়ে উঠেছেন দু:খী রাবেয়া বেগম।

জীবন সংগ্রামের এত চাপেও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে কাটানো সময় ও স্মৃতির কথা একটুকু ভুলতে পারেননি রাবেয়া বেগম। তাই সেই থেকে এক অস্থিরতা নিয়ে কাটছে তার জীবন। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক বার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অসহায় ও দু:খী বলে কোনোভাবেই শেখ হাসিনার নাগাল পর্যন্ত যেতে পারেননি রাবেয়া বেগম।

রাবেয়া বেগম বলেন, ‘আব্বা ও আম্মাসহ অন্য সবাইকে মেরে ফেলা হলেও বুবু হাসিনা ও রেহেনা নাকি তখন বিদেশে ছিলেন। তাই আল্লাহর রহমতে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা অনেক বছর দেশে আসতে না পারায় তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে বুবু প্রথম বার দেশের রাজা হলে তার সাথে দেখা করতে ঢাকায় দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখা করতে না পেরে অনেক দু:খ নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছিলাম। বুবু কক্সবাজার আসার কথা জানলে অনেকবার অনেককে বলেছি বুবুর সাথে একটি বার দেখা করিয়ে দেয়া জন্য। কিন্তু আমি অসহায় বলে কেউ আমার কথাকে গুরুত্বই দেয়নি। তাই অনেক আক্ষেপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। তবে এখনো আশায় আছি বুবুর সাথে একটি দেখা করার। যদি বুবুর সাথে দেখা করতে না পারি তাহলে আমি মরে গেলেও আমার আত্মা শান্ত হবে না।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাবেয়া বেগমের বড় ভাই কবির আহামদ বলেন, ‘বাহারছড়ায় খালার বাড়িতে এসে রাবেয়া হারিয়ে যায়। আমরা মনে করেছিলাম সে সাগরে ভেসে। আমরা অনেক তার জন্য কেঁদেছিলাম। মা-তো সব সময় কাঁদতেন। কিন্তু দীর্ঘ ১১ বছর পর ক্যাপ্টেন সোলাইমানের মাধ্যমে আমরা রাবেয়া ঢাকা বঙ্গবন্ধুর কাছে আছে বলে খবর পাই। তখন আমিসহ গিয়ে রাবেয়াকে ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিলাম। এখন মনে হয় সেখান থেকে তাকে নিয়ে আসাটা ভুল ছিলো। সে যদি সেখানে থাকতো তাহলে তাঁকে আজ ভিক্ষা করে খেতো হতো না।’

ক্যাপ্টেন সোলাইমানের পুত্র জয়নাল আবেদীন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাবেয়ার হারিয়ে থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত সব খবর জানি। বিশেষ করে বাবার মাধ্যমে তাঁর খোঁজ পাওয়ার বিষয়টির চাক্ষুস সাক্ষী আমি। পরে বাবার মাধ্যমেই তাকে তার পরিবার ফিরে পেয়েছিল।’