সৈয়দ মোহাম্মদ শাকিল:
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময় পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মম ভাবে নিহত হন নিরীহ কক্সবাজার শহরের নতুন বাহারছড়া এলাকার কবিরাজ কবির আহম্মদ। দীর্ঘ ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে জাতী পালন করছে গৌরবের ৪৬ বৎসর, কিন্তু শহীদ কবির আহম্মদের স্বজনেরা পায়নি স্বীকৃতি। ভাঙ্গা কুড়ে ঘরে অর্ধাহারে অনাহারে বিধবা আলমাছ খাতুনের দিন কাটছে। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া সহানুভুতির চিঠি আর ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ২ হাজার টাকার ছাড়া বর্তমান পর্যন্ত আর কোন সাহায্যই পাননি শহীদ পরিবারটি।
স্বাধীনতার ৪৬ বছর হলেও শহীদ পরিবারের খোঁজ রাখেনি কেউ। এখন তাদের দিন কাটছে অর্ধাহারে অনাহারে। এমনকি শহীদ কবির আহম্মদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্যও সরকারিভাবে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
১৯৭১ সালের ১২ মে কক্সবাজার শহরে কবিতা চত্বর রোড়ে পুরোনো সিভিল রেস্টহাউসে (১৬ ইসিবি দপ্তর) পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর থেকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় পাকিস্তানি হানাদাররা চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও গণধর্ষণ।
সেখানে নারীদেরকে গণধর্ষণ করার পর কখনও হত্যা, কখনও পেছনের কূয়ায় ফেলে দিতো পাকিস্তানি সেনারা। আর অন্য লোকদের রেস্টহাউসের সামনে দেওয়ালের ওপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করার পর বেয়নেট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত-বিক্ষত করে তাদের বালিচাপা দেওয়া হতো। রাত পোহালে দেখা যেতো শেয়াল-কুকুর ওইসব মরদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই মে মাসে কক্সবাজার শহরের বড়বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ধরে নিয়ে যায় শহরের নতুন বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দা আওয়ামী লীগ কর্মী কবির আহম্মদকে। সেখানে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরা নির্মম ভাবে হত্যা করে কবর দিয়ে দেন।
লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ কবির আহম্মদের স্ত্রী আলমাছ খাতুন। সে দিন ছিলো শুক্রবার । বিকালে পাকহানাদার বাহিনী আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে আমি খবর পেয়ে আমার ৪ বছর বয়সী কন্যা শাহেনা আকতার ও ৯ মাস বয়সী ছেলে নাছির উদ্দিন বাচ্ছুকে নিয়ে ছুটে যাই কক্সবাজার শহরে কবিতা চত্বর রোড়ে পুরোনো সিভিল রেস্টহাউসে (১৬ ইসিবি দপ্তর) পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্পে।
সেখানে আমার স্বামীর সাথে দেখা করারতো দুরের কথা! কথাও বলতে দেয়নি। বুকভরা দুঃখ নিয়ে ফিরে আসার পথেই শুনতে পাই ৪টি গুলি আওয়াজ। তার পর আমার সব কিছুই শেষ। সেই থেকেই স্বামী হারানোর ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা গুলো নিয়ে কত যে কষ্ট আর যন্ত্রণায় কেটে গেলো আমার জীবন। জীবন বাচানোর জন্য শামুক ঝিনুক গেঁথে, মালা বানিয়ে বিক্রি করেছি। সুখে অসুখে ঝিনুক মালা গাঁথুনি ঠিকই ঠিক রেখেছি। এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি।
১৯৭২ সালে শহীদ কবিরের স্ত্রী আলমাছ খাতুন দেয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত সহানুভুতি পত্রটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

‘প্রিয় ভাই বোন,

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য পুত্র/পিতা/স্বামী/ মা/ স্ত্রী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদন। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভুতি।
এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের পুত্র/পিতা/স্বামী/ মা/ স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করায় সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের নিকট ২০০০/= টাকার চেক প্রেরিত হলো। চেক নম্বর-০০৫৯৩৪।আমার প্রাণ ভরা ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।

‘শেখ মুজিব’।

আলমাছ খাতুন বলেন, আমাদের আর এখন কেউ খোঁজ নেয় না । কোন রিলিফও পাই না।
কক্সবাজার শহরের নতুন বাহারছড়া এলাকায় চারিদিকে বেড়া, উপরে পলিথিন আর নারিকেল পাতা ছাউনিযুক্ত ঝুপড়ি ঘরেই বসবাস শহীদ পরিবারটির।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হলেও কোনও সরকারই গণহত্যায় শহীদদের এই গণকবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করে কি লাভ হলো?
তিনি জানান, আমার স্বামী বাজারে ওষুধ বিক্রি করতে, ফুটপাতে মজমা বসিয়ে কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালাতেন। স্বামী হারানোর পর একেবারে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। বেচে থাকার জন্য ৭১ বছর বয়সেও ঝিনুকের ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। আয়ের আর কোনও ব্যবস্থা না থাকায় পরিবারের সদস্যদের অনাহারে অর্ধাহারে জীবন কাটছে। বয়স্ক ভাতাটুকুও জোটেনি তার ভাগ্যে। বর্তমানে অসুস্থ রয়েছেন আলমাছ খাতুন। বর্তমানে তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলতে পারেন না। অর্থাভাবে তার নুন্যনতম চিকিৎসা করানো কঠিন হচ্ছে।
বিধাব আলমাছ খাতুনের এখন একটিই দাবী, বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যাতে আমাকে একটু মাথা গুজার ঠাঁই করে দিবেন।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৬ বছরেও স্বজনহারা পরিবারটির খোঁজ নেয়নি কেউ। জোটেনি শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি কিংবা সরকারি সংবর্ধনা। তবে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার- আলবদরদের বিচার হবে বাংলার মাটিতে এ আশা নিয়েই বেঁচে আছেন শহীদের স্বজনেরা।