সিবিএন ডেস্ক:
ব্যাটলিং বেগমস হলেন তারা দু’জন। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ এবং খালেদা জিয়া। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা নিয়ে যে মিথ রয়েছে তার দাবিদার উভয়েই। ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের জনক’ শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হলেন শেখ হাসিনা। মিসেস জিয়া হলেন জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী। মুজিবের অধীনস্থ আর্মি অফিসার জিয়া ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে মর্যাদাপ্রাপ্ত। তবে তিনি হয়তো ১৯৭৫ সালের ক্যু, যা মুজিবের মৃত্যু ডেকে এনেছিল, তিনি তার জন্য পরিচিত হবেন। ১৯৮১ সালে একদল বিদ্রোহী সৈন্যের হাতে নিহত হওয়ার আগে তিনি একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন। উভয় ব্যক্তিই স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা অনুশীলন করেছেন। তারা পুরোনো হিসাব চুকাতে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর জিয়া স্পষ্টতই একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ইসলামকে পাদপ্রদীপে এনেছিলেন। যদিও এখন দুই দলের পক্ষেই তাদের উভয়ের স্মৃতিতে বার্নিশ করার কাজ চলছে। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং বেগম জিয়ার বিএনপি তাদের উত্তরাধিকার বয়ে চলেছেন।
১৯৯১ এবং ২০০৬ সালের মধ্যে মিসেস জিয়া দুবার এবং শেখ হাসিনা একবার ক্ষমতায় আসেন। অবশ্য এর জন্য প্রতিটি নির্বাচনের আগে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ধন্যবাদ দিতে হয়। ক্ষমতা বদলের ওই প্রতিযোগিতার কারণে ক্ষমতার কিছু খারাপ অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। এই পর্বের আগে বাংলাদেশ প্রেসকে অতটা স্বাধীন হতে দেখা যায়নি। অবশ্য দুই নেত্রীর শাসনামল কোনো স্বর্ণযুগ ছিল না। বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ে সরকার ব্যবস্থাকে হতাশ করে দিতে এমন কোনো উপায় নেই যা তারা অনুসরণ করেনি। তারা সংসদ বর্জন করেছে। হরতাল ও ধর্মঘট দিয়ে অর্থনীতি অচল করেছে। ক্ষমতায় থাকতে উভয় দলই লুটপাটে মনোযোগ দিয়েছে। এদিক থেকে বিএনপি তার দ্বিতীয় মেয়াদে বিশেষ করে অত্যন্ত খারাপ ছিল।
ভেঙে গেল নিয়মিত পালাবদল
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলেন, তিনি অধিকতর কাঠিন্য প্রদর্শন করলেন। তিনি তার পুরনো শত্রুদের রুখতে উৎসাহী হলেন। এরমধ্যে কিছু বিষয় ছিল পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার যুদ্ধের আমলের। তিনি যুদ্ধকালের অপরাধ বিচারের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেন। বিচারের দরকার ছিল, কিন্তু ট্রাইব্যুনাল খুবই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। অভিযুক্তদের অধিকার রক্ষায় তাতে ব্যত্যয় ঘটে। ওই বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ছাপ ছিল স্পষ্ট। ওই ট্রাইব্যুনাল খালেদা জিয়ার একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাসহ অর্ধডজন বিবাদীর ফাঁসি কার্যকর করেছে।
বিএনপির সাবেক কোয়ালিশন অংশীদার জামায়াত ইসলামী ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্য আরো কিছু উপায়ে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে পর্যদুস্ত করেছেন। মিসেস জিয়া, যিনি কিছুটা দুর্বলতার লক্ষণ স্পষ্ট করেছিলেন, তার লন্ডনে নির্বাসিত পুত্র তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তার দেশে ফেরা সম্ভব হয়নি। ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে রাজি হননি। আর তখন খালেদা জিয়া নির্বাচন বয়কট করে।
বর্তমান সংসদে খালেদা জিয়ার কোনো সদস্য নেই। আর তাতে খালেদা জিয়ার কর্তৃত্বে ভাটার টানা পড়েছে। অবশ্য তিনি গ্রাম এলাকায় তার সমর্থন ধরে রাখতে পেরেছেন। সরকার যেহেতু তার পেছনে লেগেই ছিল, তাই মনে হয়েছে খালেদা জিয়ার ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়ে পড়েছে।
আওয়ামী লীগ এবং নরেন্দ্র মোদি সরকারসহ বিদেশি বন্ধুরা একটি নবযুগ উদযাপন করেছে। ক্ষমতার পালাবদল ও হরতালের রাজনীতি অতীতের বিষয়ে পরিণত করা সম্ভব হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে স্থিতি এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। নীতি নির্ধারণ অনেক বেশি স্থিতিশীল হতে পেরেছে। সরকার বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সড়ক নির্মাণ করতে পেরেছে। গত এক দশকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশ স্থির থেকেছে এবং সামনের বছরগুলোতে এই প্রবৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে শতকরা প্রায় ৭ ভাগে উন্নীত হওয়ার পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হয়েছে। শিশু মৃত্যু হারের মতো কতিপয় উন্নয়ন সূচক ভারতের চেয়ে লক্ষণীয়ভাবে ভালো। হেনরি কিসিঞ্জার একদা যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহিনী ঝুড়ি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেই ধারণার অবসান ঘটেছে।
শেখ হাসিনা যদি রাজনীতি বিলোপ করে থাকেন, তাহলে তার মাশুলও গুনতে হয়েছে। দলাদলির পরিবর্তে শাসক দলের অভ্যন্তরেই নিষ্ঠুর আন্তঃকলহ দেখা গেছে। দুর্নীতি আগের মতোই মারাত্মক রয়ে গেছে। হাজারীবাগের ট্যানারির মতো কিছু কারখানা আবাসিক এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া যায়নি। আর তা স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের প্রতি বিরাট হুমকি তৈরি করে রেখেছে।
সংবাদপত্র আওয়ামী লীগ কিংবা শেখ হাসিনার সামান্যই সমালোচনা করে থাকে। যেসব প্রকাশনা কথিত মতে নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে যায়, তাদেরকে তাড়া করা হয়। বৃহত্তম ইংরেজি দৈনিক স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে মানহানি ও অন্যান্য অভিযোগে ৮৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নতুন আইনটি নিবর্তনমূলক, আর তা অনলাইন মিডিয়ার জন্য হুমকি বয়ে এনেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সরকারি ভাষ্যের সমালোচনাকেও অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সরকারকে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে একটা অন্যতম মাধ্যম ছিলেন। গত অক্টোবরে তিনি যখন দেশের বাইরে ছিলেন, তখন তার অনুপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ আনা হয়। চাপের মুখে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ধীরে ধীরে আরো বাড়ছে। সন্ত্রাস দমন ইউনিট র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মতো নিরাপত্তা সংস্থার অংশবিশেষ প্রায় দায়মুক্তি ভোগ করছে। ২০১৪ থেকে শত শত বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকরা গ্রেপ্তার বা অপহরণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮০ জনের বেশির ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে শুধু চলতি বছরেই। অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। এদিকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসীদের ইসলামী উগ্রপন্থিদের কবল থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও ২০১৩-২০১৬ সালের তুলনায় তাদের দ্বারা সংঘটিত মারাত্মক হামলাগুলোর প্রকোপ চলতি বছরে কমেছে। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে একটা সাধারণ নির্বাচন করতে হবে। এর দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই মনে হচ্ছে হানাহানিপূর্ণ রাজনীতির যে ধারার বিলোপ ঘটেছিল, সেটা ক্রমশ আরো বেশি উদগ্র হতে দেখা যাবে। ২০১৩ সালে সৌদি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাহায্যপুষ্ট রেডিক্যাল হেফাজতে ইসলামী অধিকতর ধার্মিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে নেমেছিল। কর্তৃপক্ষ স্কুলের পাঠ্যপুস্তক পুনর্লিখন এবং সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখ থেকে গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণ করেছে। উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার সুনাম ক্ষুণœ হওয়া একটি ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নিজেদের উৎফুল্ল মনে করতে পারে। আর মিয়ানমারের সামরিক উন্মাদনার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু উগ্রপন্থি নিয়োগের একটি কার্যকর ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য হবে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, দুর্বল পরিবেশ বিষয়ক রক্ষাকবচ, নমনীয় আদালত আর তরুণ শিক্ষিত বাংলাদেশি যারা মনে করে যে, উত্তম কানেকশন না থাকলে ভালো কোনো চাকরি মিলেবে না, সেই সঙ্গে উগ্রপন্থার দ্রুত বিকাশের আশঙ্কার মধ্যে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হওয়ার সম্ভাবনাকে অনেকটাই নস্যাৎ করছে।