বাংলাট্রিবিউন:
ভ্রাম্যমাণ আদালত২০১১ সালে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের ১১ জন কর্মকর্তা তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবুল হাসেমের বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগে কর্মকর্তারা ইউএনও’র বিরুদ্ধে সরকারি কাজে নানা অনিয়ম এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ করার বিষয়টি প্রকাশ করেন। পাশাপাশি জামালগঞ্জের সাচানা বাজারের ৭০ জন ব্যবসায়ী জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেন,ইউএনও আবুল হাসেম বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নাম করে তাদের কাছ থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এই দুটো ঘটনা নিয়ে আঞ্চলিক পত্রিকা দৈনিক সিলেট বাণী একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পত্রিকাটির রিপোর্টার আকবরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন ওই ইউএনও। হুমকির পর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ইউএনও সাংবাদিক আকবরকে সাজা দেন।

সাংবাদিক আকবর মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। ক্ষমতার অপব্যহারের কারণে আদালত তৎকালীন ইউএনও আবুল হাসেমকে ছয় মাসের জন্য ওএসডি’র নির্দেশ দিয়েছিল।

এ ঘটনার ছয় বছর পর গত সোমবার (৪ ডিসেম্বর) লক্ষ্মীপুর শহরের কাকলি স্কুলের প্রবেশ পথে আবারও ঘটে ক্ষমতার অপব্যবহারের আরেক উদাহরণ। স্কুলের গেটে গাড়ি আগে-পরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মুর্শিদুল ইসলাম ও ডা. সালাহ উদ্দিন শরীফের বড় ছেলে মিনহাজের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এসময় ডা. সালাহ উদ্দিন এগিয়ে এসে পরিচয় জানতে চান।কিন্তু এডিসি পরিচয় না দিয়ে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়লে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়।পরে এডিসি শেখ মুর্শিদ ইসলাম পুলিশ দিয়ে ডা. সালাহ উদ্দিনকে স্কুল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নিয়ে যান এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনে তিন মাসের সাজা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আইনজীবীরা বলছেন, ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অপব্যবহারের শঙ্কার কথা আগে থেকেই বলা হয়েছে। এই ক্ষমতার অপব্যবহার হবেই এটা অবধারিত। কারণ, যে ব্যক্তি অভিযোগ করছেন, তিনিই তদন্ত করছেন, আবার তিনিই বিচার করছেন। এটি হতে পারে না। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হলে সেটি হতে হবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে। কোনোভাবেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এই ক্ষমতা দেওয়া যাবে না।

গত ১১ মে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা সংক্রান্ত ২০০৯ সালের আইনের ১১টি ধারা ও উপধারা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে, এই আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া সংবিধানের লঙ্ঘন এবং তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আঘাত করেছে। এটি ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতিরও পরিপন্থী। রায়ে বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ কর্ম-কমিশনের সব সদস্যরা প্রশাসনিক নির্বাহী। একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তারা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না। পরে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত করেন সর্বোচ্চ আদালত।

এদিকে, ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আরও সক্রিয় করতে দোষ স্বীকারের ভিত্তিতে অপরাধীকে সাজা দেওয়ার বিধান বাতিল করে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করা হচ্ছে। সংশোধিত আইনে দোষ স্বীকার না করলেও চাক্ষুষ প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার পাবেন।

লক্ষ্মীপুরে সোমবারের ঘটনায় মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজীম। এই রিটের ভিত্তিতে আদালত এডিসি শেখ মুর্শিদুল ইসলাম ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নূরুজ্জামানকে হাইকোর্টে তলব করেছেন।

হাইকোর্টের রায় স্থগিত করা মানে রায়টি না থাকা নয় উল্লেখ করে ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজীম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইনটি অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্ট ইতোমধ্যে রায় দিয়েছেন। রায়টি বর্তমানে স্থগিত আছে, কিন্তু বাতিল হয়নি। যেহেতু আইনটি বিদ্যমান নেই, ফলে এখন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করাটাই অবৈধ।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে চাঁদাবাজিও চলছে। একটি ঝগড়াকে কেন্দ্র করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমের অপব্যবহার করা হলো। অপব্যবহারের যে সুযোগ আছে, সেটি এ ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয়েছে।’ এ বিষয়ে করণীয় জানতে চাইলে ব্যারিস্টার আজীম বলেন, ‘বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয় সেটির কোনও সুযোগ নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকারই দরকার নেই। থাকলেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সেটি পরিচালনা করতে পারবেন না।’

বর্তমান পদ্ধতিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত জারি রেখে স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনের হস্তক্ষেপের আকাঙ্ক্ষা প্রতিয়মান হয় উল্লেখ করে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের কনসেপ্ট মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর বিলুপ্ত হয়েছে। এটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সংঘর্ষিক। বিষয়টি বর্তমানে আপিলে রয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হলে মতদ্বৈততাগুলো দূর হবে।’ তিনি বলেন, ‘বিচারিক আদালতের শৃঙ্খলাবিধি গেজেট না করার প্রশাসনের যে প্রবণতা- তা থেকে বুঝা যায়, প্রশাসন বিচারবিভাগে হস্তক্ষেপ করতে চায়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতার অপব্যবহার হবেই, এটা অবধারিত। কারণ, যে ব্যক্তি অভিযোগ করছেন, তিনিই তদন্ত করছেন, আবার তিনিই বিচার করছেন।’

তাহলে করণীয় কী, জানতে চাইলে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় আরও বলেন, ‘এটি বিলোপ করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে বিষয়টি যৌক্তিক হবে। ইমিডিয়েট ব্যবস্থা থাকা উচিত না- এটি বলছি না,বলতে চাচ্ছি বিষয়টি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় হতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বিচার ব্যবস্থার নীতির সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। এ কারণে এটি থাকা উচিত না। সোমবার লক্ষ্মীপুরে সংঘটিত সাবেক সিভিল সার্জনের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এই সিভিল সার্জন দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করেছেন। তাকে যে হেনস্তা করা হলো, তা দুঃখজনক। যারা ঘটনাটি ঘটালেন, তাদের বিচারের অধীনে আনা উচিত এবং বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’