পরিবার নিয়ে ৩৭ বছর ধরে ভাড়াঘরে মানবেতর জীবনযাপন

আবদুল মজিদ, চকরিয়া:
চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের মুসলিম পাড়ায় স্ত্রী এক ছেলে ও চার মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে এক বয়োবৃদ্ধ অসহায় মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির। তাঁর পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত কয়েক কোটি টাকার ভূসম্পদ জবর দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এসব সম্পদ থাকার পরেও আর্থিক অভাব অনটনের কারণে মেধা ও প্রতিভা থাকার পরেও ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছেন না অসহায় মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির।

মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবিরের সাথে আলাপ করে জানা যায়, তাঁর পূর্বের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর কলাউজান গ্রামের মহাজন পাড়ায়। তাঁর পিতার নাম ছিল মৃত জ্যোতিষ দাশ এবং তাঁর নাম ছিল দীলিপ কুমার দাশ। ১৯৮০ সালে বিশ্বনবী হয়রত মুহাম্মদ (স:)-এর জীবনাদর্শে মুগ্ধ হয়ে চুনতির মরহুম শাহ সাহেব কেবলা হাফেজ আহাম্মদ শাহ সাহেব (র:)-এর নিকট কালেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন মুক্তিযোদ্ধা দীলিপ কুমার দাশ এবং তাঁর নাম রাখা হয় হুমায়ুন কবির।

হুমায়ুন কবির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহসিকতার সাথে রনাঙ্গনে যুদ্ধ করেন। তাঁর দেয়া তথ্যমতে যুদ্ধকালীন এক নম্বর সেক্টরে সংশ্লিষ্ট গেরিলা বাহিনী গ্রুপ কমান্ডার একে এন শামসুল ইসলাম ও কমান্ডার মোঃ রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেন মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ন কবির। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হলোও সম্প্রতি তাঁর নাম মুক্তিযুদ্ধের যাচাই বাছাই তালিকায় উঠলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে এখনো কোন সাহায্য সহযোগিতা পাননি তিনি। তাঁর সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া তাঁর বড় ভাই আশুতোষ দাশ মহাজনকে ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চ শনিবার দুপুরে কলাউজান গৌরসুন্দর মহাজন বাজারে প্রকাশ্যে দিবালোকে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে সিরাজ সিকদার বাহিনী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা । ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা আশুতোষ দাশকে নির্মমভাবে হত্যা করার অপরাধে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন যার (মামলা নং ৩৯৬ জি.আর-৫৪/৭৫, সি.এস-৯২,) ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন যথাক্রমে এস আই এফ হক, এ এস পি-এস রহমান) হত্যাকান্ডের দিন রাতে ঘরোয়াভাবে দলের পার্টি বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন দলীয় নেতৃবৃন্দদের মধ্যে মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী, আতউর রহমান খাঁন কায়ছার, এম ছিদ্দিক এম.পি, ডা. ফয়েজ, আবু ছালেহ এম এন এ, রূপন চৌধুরীসহ আরো অনেকেই। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই দুই ভাইকে লাইসেন্সসহ ২টি বন্দুক ও ২টি পাসপোর্ট উপহার দেন। বন্দুকের সিরিয়াল নং- ১২১৩ বি,পি,পিÑনম্বর ১৩৪ (সেকশন রুল) পাসপোর্ট নং Ñ বি ০৮২৯৮।

এ জঘন্য ঘটনার পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির ও তাঁর বড় ভাই আশুতোষের পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারে অন্যান্য সদস্যদের স্ব-পরিবারে হত্যা করার পর এই দুই মুক্তিযোদ্ধার খোঁজখবর কেউ রাখেন নি। মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির তাঁর জীবনের স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিবেদক কে জানান, দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পায়নি আমি এবং আমার পরিবার। বর্তমানে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অতীব কষ্টে দিনাতিপাত করছি। তিনি আরও জানান, ১৯৭৫ সালের ২১ই আগস্ট তৎকালীন ২৫০ জন সেনাবাহিনী তাঁর পূর্বের পৈত্রিক বাড়ি থেকে তাঁকে সিকিউর (অপহরণ) করে নিয়ে যায়। তিন দিন ধরে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারি আর্মি ক্যাম্পে আটকে রেখে ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি না করার জন্য মুচলেখা নেন।

গত ৩৭ বছর ধরে তিনি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের মুসলিম পাড়ায় তাঁর শাশুড় বাড়ির পার্শ্বে একটি ভাড়াটিয়া কুড়েঁঘরে দূর্বিসহ্ জীবনযাপন করছেন। চট্টগ্রামে লোহাগাড়ার সম্ভান্ত জমিদার পরিবারের ঘরে জন্ম নেয়া মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবিরের পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত কয়েক কোটি টাকার সম্পদ তাঁর অসহায়ত্বের সুযোগে জবর দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। তাঁর দেয়া তথ্য মতে চট্টগ্রামের কলাউজান, লোহাগাড়া, কক্সবাজারে চকরিয়া উপজেলা হারবাং ও মানিকপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৭৭ একর জমি থাকলেও বর্তমানে এক কড়া জমিও তাঁর দখলে নেই। তিনি অভিযোগ করে বলেন, হারবাং ইউনিয়নের রোসাঙ্গাপাড়া এলাকার শামসুল ইসলামের পুত্র সাইফুল ইসলাম (টিটু) তাঁর থেকে ৮০ শতক জমি জবর দখল করে নিয়েছে। ওই সব জমি উদ্ধারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

একদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত অপরদিকে পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত জমিজমা হারিয়ে অসহায় মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন বর্তমানে একটি ভাড়াটিয়া কুঁড়েঘরে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।