এইচ এম আবু ছিদ্দিক :

জেনোসাইড মানব সভ্যতার অশনি সংকেত শিরোনামে আজকের প্রবন্ধটি ছোট্ট পরিসরে লেখা হলেও এর তাৎপর্য বিশ্ব মানবজুড়ে। জেনোসাইড (Genocide) অভিধানিক অর্থে হত্যাকান্ড দ্বারা কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর বিলোপসাধন, বা পরিকল্পিত ব্যাপক হত্যাকান্ড, বা গণহত্যা। মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী গত কয়েক দশক ধরে আরকানের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের যেভাবে জেনোসাইড বা গণহত্যা চালিয়ে তাদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এটা কোন সভ্য জাতির সংস্কৃতি হতে পারেনা। এদের কুপরিকল্পিত রোহিঙ্গা (মুসলিম) জাতি নিধন ইতিহাসে নজিরবিহীন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে পূর্বের সংবিধান বাতিল, স্বৈরাচারী সামরিক শাসন জারি, ১৯৮২ সালে বিতর্কিত আইনে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠির নাগরিকত্ব বাতিল, এবং গণতন্ত্রের ভূত অংসান সুচির মুসলিম বিদ্বেষতন্ত্র ও সর্বশেষ রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে বিনাশ মিশন ২০১৭, অনেকটা শেষ পর্যায়ে। ইতিমধ্যেই আরকানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী। গর্ভবতী নারী-শিশু ও বয়োবৃদ্ধাসহ প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আবাসভূমি ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দেশের সর্বস্তরের মানুষ রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়ে অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসাসহ সাধ্য মতো সেবা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। যা ইতিহাসের পাতায় মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত। শত শত ভাসমান লাশ সাগর থেকে উদ্ধার করেছে বাংলাদেশের কোস্টগার্ড ও স্থানীয়রা। আরও কত লাশ মহাসাগরে ভেসে গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। বিশ্ব নেতারা শুধু ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ মনে করা মোটেও সমীচীন নয়। রোহিঙ্গাদের ইতিহাস জেনে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা প্রত্যেক মানুষের মানবিক দায়িত্ব। মিয়ানমার দেশটি রোহিঙ্গা মুসলিম জাতিগোষ্টীর প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহনে স্বাধীনতা পেয়েছে। সেই দেশের সশস্ত্র বাহিনী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেয়ার পরিবর্তে খুন-ধর্ষণ, লুটপাটসহ ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বহিঃপ্রকাশ নয় কি? বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যম কর্মীদের রাখাইন রাজ্যে ঢুকতে দেয়া হয়নি। স্যাটলাইটে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ ইউটিউব প্রকাশ না করলে বিশ্ববাসী হয়তো জানতেও পারতোনা মিয়ানমার সশস্ত্র সেনাদের কুপরিকল্পিত রোহিঙ্গা (মুসলিম) জাতি নিধনের ভয়াবহ চিত্র। ইতিমধ্যেই মোবাইল সাংবাদিকসহ যারা হত্যাযজ্ঞ ও বাড়ীঘর জ্বালানোর চিত্র বিদেশে পাঠিয়ে দিতো, তাদের ধরে নিয়ে গুম করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বিশ্ব মানবতাবাদীদের সমালোচনার তোপের মুখে মিয়ানমার সশস্ত্রবাহিনী এখন আগের মতো গণহারে রোহিঙ্গাদের হত্যা করেনা, বা ঢালাওভাবে তাড়িয়ে দেয়না। কৌশল পাল্টিয়ে নিজ ঘরে বন্দি রেখে খাদ্যদ্রব্য বন্ধ করে অভুক্ত মারে। সীমান্তের ওপারে এখনও মাঝে মধ্যে গুলির শব্দ ও আকাশে কালো ধোঁয়া দেখা যায়। প্রতিনিয়ত কোন না কোন উপায়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মিয়ানমারের ইচ্ছা অনুযায়ী তারা যেভাবে চাইছে, সেভাবেই একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এই চুক্তিতে ১৯৯২ সালের পুরানো চুক্তি অনুসরণে গত বছরের ২৫ আগষ্টের পর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে, মিয়ানমার শুধু তাদেরই ফেরত নেবে। তবে নিজের ভিটা-মাটিতে নয়, অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে থাকবে রোহিঙ্গারা। ১৯৯২ আর ২০১৭ সালের প্রেক্ষাপট মোটেও এক নয়, এবারে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করায় বাংলাদেশ প্রচুর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণধর্ষণ ও গণহত্যাসহ তাদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হিসাবে বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণ ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ মানবাধিকারের বিষয়ে কোন রকম দর কষাকষি ছাড়াই অসমীচীন চুক্তিতে কেন বাধ্য হলো বাংলাদেশ, সেটা বলা সময়সাপেক্ষ। তবে ভাসানচরে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকায় অস্থায়ী আবাসন প্রকল্প মন্ত্রীসভা অনুমোদন দেয়ায় অনুমান করা যায়, রোহিঙ্গারা সহজেই প্রত্যাবাসন হচ্ছে না। চুক্তি সম-অসম যাই হোক, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অতীত ইতিহাস অত্যন্ত দুর্বল। সুতরাং আগামীতে বাংলাদেশকে যেকোন সমঝোতার বিষয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য। বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও রাশিয়াসহ বিশ্ব নেতাদের উপলব্ধি হওয়া একান্তই প্রয়োজন। মানুষ কতটা নির্যাতনের শিকার হলে নিজের বাড়ীঘর সহায়-সম্ভল ত্যাগ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভেলায় চড়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেয়া তথ্যমতে, অধিকাংশ যুবতী মেয়েদের ধর্ষণসহ কর্মক্ষম পুরুষদেরও হত্যা করেছে মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী। সাম্প্রতিক কিছু সংগঠনের ব্যানারে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠিয়ে দিতে পারলেই নিজেকে নিরাপদ মনে করছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণসহ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বিষয়ে মোটেও ভাবছে না। তাই যদি হয় আমাদের উদার মানবতা, বা শাসকদলের মাদার অব হিউম্যানিটি দু’টিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে অমানবিকতায় রূপান্তরিত হতে পারে। তাছাড়া প্রতিবেশীরা আমাদেরকে দুর্বল ভাবারও সুযোগ থেকে যায়। নির্যাতিত মজলুম রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়ে মানবতার পাশে যখন দাঁড়িয়েছি, আরও শক্ত করে দাঁড়াতে হবে। নৈতিকতার দায়বোধ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মানবাধিকারসহ বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। বহুপাক্ষিয় আলোচনা ছাড়া দ্বিপাক্ষিয় সমঝোতায় হয়তো সামান্য কিছু রোহিঙ্গাদের আপাতত ফেরত নিলেও মিয়ানমারের অতীত ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, কৌশলে আবার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেবেনা তার নিশ্চয়তা মিয়ানমার দেয়নি। গুটি কয়েক শাসকগোষ্ঠী ছাড়া বিশ্ব জনমত বিপন্ন রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। সেটাকে কুটনীতিবিদরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে আশ্রয়দাতা ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হবে মিয়ানমার জান্তা সরকার। প্রয়োজনে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের সাথে নিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে যাওয়ার যথেষ্ট আইনি সুযোগ রয়েছে। তবে আমাদেরকে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ ঝগড়া ব্যতিরেকে মেরুদন্ড শক্ত করে দাঁড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টির দেয়া তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মানস বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের গভেষক অধ্যাপক গ্রেগরিসহ বিশ্ব মানবাধিকার কর্মীরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিধনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, বা জেনোসাইড আখ্যা দিয়ে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। তাছাড়া মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালত বা পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) অসংখ্য স্বাক্ষ্য-প্রমাণসহ অংসান সুচি ও মিয়ানমার সেনাপ্রধানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, মিয়ানমারে সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা জাতিগত নিধনযজ্ঞ হয়েছে, এবং হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িতদের বিচার হওয়া উচিত। অথচ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ তদন্ত রিপোর্টে গণহত্যাকে অস্বীকার করে রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালী সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে উল্টো তাদেরকে দায়ী করছে। সাম্প্রতিক মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিডোতে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংসান সুচি সন্ত্রাস দমন ও উন্নয়নের প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেও রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে এটাও জানিয়ে দিয়েছেন, রাতারাতি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। তার এমন কৌশলী বক্তব্যই প্রমাণ করে অংসান সুচি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে নোবেল মার্কা সুচি কি ক্ষুধার্ত রাজনীতিবিদে রূপান্তর হয়েছেন? তিনি কি এতোদিন বেমালুম ছিলেন। রোহিঙ্গারা আরকানের ভূমিপুত্র হয়েও সেখানে তাদের পর্যাপ্ত শিক্ষা, চিকিৎসা, অবাধ চলাফেরা ও ব্যবসা-বানিজ্যসহ নাগরিক সুযোগ-সবিধা বলতে কিছুই নেই। এক কথায় মানবাধিকার বলেন, বা সার্বভৌমত্বের অধিকার বলেন, সবকিছুই কেড়ে নিয়েছে মিয়ানমার জান্তা সরকার। প্রকৃতি রোহিঙ্গাদের নিয়মিত আলো-বাতাস সরবরাহ করলেও মানুষ নামের নরপশুর তালাবদ্ধ কারাগারে বন্দি রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিগত কয়েক দশক আগেই রোহিঙ্গাদের ওপর জেনোসাইড প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আরকানে একজন বৌদ্ধ মহিলার হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে প্রায় ১ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত সতর্কতার সাথে পর্যালোচনা করলে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, মিয়ানমার জান্তা সরকার গণহত্যা চালিয়েছে। এরা মানবতাবিরোধী অপরাধী ও অসভ্য মোড়লদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মিয়ানমার সেনাবাহিনী কুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নিধনকে গণহত্যা বলেন, বা মানবতাবিরোধী অপরাধ বলেন, বা জেনোসাইড বলেন। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ রোহিঙ্গা নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ হত্যার বিচার চায়। রোহিঙ্গাদের ভিটে-মাটি দখল করে যারা বানিজ্য মেলা করতে চায়, তাদেরও বিচার হওয়া অত্যাবশ্যক। আরকানের ভূমিপুত্র নিরীহ-নিরপরাধ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জেনোসাইডকারী মিয়ানমার জান্তা সরকারের সেনাপ্রধানসহ দোষী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি নাহলে গোটা বিশ্বকেই মাশুল দিতে হবে। বিধায় বিশ্বনেতাদের কাছে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন রইল। সবখানে সব জায়গায় মানবাধিকারের কথা বলার প্রবচন যদি সত্যি হয়, তাহলে নিরীহ-নিরপরাধ রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার গেল কোথায়? রাজনীতি বা কূটনীতির মাঠে বিশ্বমোড়লেরা একদিকে মানবাধিকারের বাণী শুনায়, অন্যদিকে গণহত্যাকারীদের সাথে এক টেবিলে বসে খায়। এক কথায় “চোরে চোরে কুটুম্বিতা” অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার অমনি-অমনি আসেনি, তা আদায় করে নিতে হয়েছে। বর্তমানেও বিপন্ন মানুষের অধিকার আদায়ে বিশ্ব নাগরিক সমাজকেই একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পূর্বকালীন সময় আর বর্তমান আধুনিক বিশ্বের মানুষ এক নয়। এক সময় রাজাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসতে পারলেই অন্যান্যরা তাকে রাজা বলে মেনে নিতো। কালের বিবর্তনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে জ্ঞানীগুণীরা পৃথিবীতে অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি, আচার-আচরণ, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলাসহ জীবনমান অনেকটা বদলে গেছে। মানুষ এখন ক্ষমতার জোরে সিংহাসনে বসাকে অবৈধ শাসক ও শোষক বলে মনভরে ঘৃণা ও প্রত্যাখান করে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক যুগে অধিকাংশ মানুষ অন্তর্নিহিত শক্তি দ্বারা ন্যায়-অন্যায়, ভালমন্দ, যোগ্য-অযোগ্য সবকিছুই বিবেচনা করতে সক্ষম। তবে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীরাও থেমে নেই, নিজেদের সুবিধা মতো মনগড়া আইন বানিয়ে তাদের অবৈধ কর্মকান্ডকে বৈধতা দিতে অনেকটা সফল হয়েছে। যেমন, ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে পূর্বের সংবিধান বাতিলসহ স্বৈরাচারী সামরিক শাসন জারি করতে সক্ষম হয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সেই অবৈধ সেনাশাসক ১৯৮২ সালে এক বিতর্কিত আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়, যা সম্পূর্ণ অবৈধ ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। এখন আলোচনার বিষয় হচ্ছে, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সেনাশাসক মিয়ানমারের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারে কিনা? বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির সভ্যযুগে যেসব দেশের শাসকেরা দ্বিপাক্ষিয় সমঝোতার নামে জেনোসাইডকে আড়াল করে মানুষ হয়েও রোহিঙ্গাদের গরুর মতো গোয়াল ঘরে বন্দি করতে বদ্ধপরিকর। তদেরকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ জানাচ্ছি, অন্তত একবার হলেও কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা অনাথ শিশুদের নিজ চোখে দেখে আসতে। সেখানে আশ্রয় নেয়া অনাথ শিশুরা কেউ মা-বাবাকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছে। ভাই যুবতী বোনকে গণধর্ষণের পর জবাই করে হত্যা করতে দেখেছে। বোন ভাইকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে দেখেছে। এসব কোমলমতি শিশুরা কি অপরাধ করেছিল? পৃথিবীকে জানার আগেই কেন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো? কিসের লোভে অত্যাচারী মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসরেরা কুপরিকল্পতভাবে এদের বাবা-মাকে হত্যা করলো? এসব মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে জোর প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রত্যেক সভ্য মানুষের নৈতিক ও মানবীয় দায়িত্ব। আগামী প্রজন্মের জন্য হানাহানিমুক্ত সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী সাজাতে চাইলে, অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলাসহ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বন্ধ করতে হবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এভাবে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চলতে থাকলে মানবতা বিপন্ন হওয়া ছাড়াও গোটা বিশ্ব মাৎস্যন্যায় পরিণত হবে। গুটি কয়েক পুঁজিবাদী শাসকের নির্বোধ কৃতকর্মের কারণে সারা বিশ্বের মানুষ অশান্তি ভোগ করবে, সেটা হতে দেয়া যায় না। বর্তমান বিশ্বে যেভাবে অস্ত্র-শস্ত্র ও গুলা-বারুদ তৈরী করে বেচা-কেনাসহ নিরপরাধ মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতা চলছে, এটা গোটা মানবজাতির জন্য অশনি সংকেত। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে। ধর্ম যার যার মানবাধিকার সবার। প্রয়োজনে মালয়েশিয়ার মতো প্রত্যেক দেশে দেশে গণ-আদালত গঠন করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিচার করা অত্যাবশ্যক। মিয়ানমার ছাড়াও পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে সাধারণ নাগরিকের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী। তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক যুগে সবকিছুতেই উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু কিছু জ্ঞানপাপী শাসকের বর্বর কর্মকান্ডে আজ পুরো মানবজাতি আতঙ্কিত। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূলসূত্র হচ্ছে, ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক শোষন। শাসকশ্রেনীর ক্ষমতার আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা, বা প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। সুতরাং এই মূহুর্তে নির্যাতিত নিরপরাধ মানুষের অধিকার আদায়ে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা, বা প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য। সেটি কিভাবে গঠন হতে পারে পরবর্তী লেখায় আলোচনা করার চেষ্টা করব। আজকে শুধু প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে যাত্রা শুরু করলাম, ‘বিশ্ব নাগরিক সংঘ’। প্রিয় পাঠক, রোহিঙ্গা জেনোসাইড নিয়ে বিশ্বনেতাদের টালবাহানার সংক্ষিপ্ত বিবরণী তুলে ধরেই লেখাটি শেষ করব। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ও বর্তমান মহাসচিব আন্টোনিও গুতারেস মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ ও তাদের নাগরিকত্বসহ পূর্ণবাসনের আহবান জানান। এরপরও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। খ্রিষ্টীয় ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসকে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ না করার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মিয়ানমার। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসেছে। তবে চীন ও রাশিয়ার ভেটোতে সব সিদ্ধান্ত ভেস্তে গেছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, গুটি কয়েকজন ছাড়া বিশ্বমোড়লেরা মুখে মানবাধিকারের ফাঁকা বুলি ছোড়লেও জেনোসাইড বা গণহত্যা শব্দটি ভুলেও উচ্চারণ করেননি। এমনকি কফি আনান কমিশনের তদন্ত রিপোর্টেও গণহত্যার দায়ে মিয়ানমার সরকারকে অভিযুক্ত করার নুন্যতম দায়বদ্ধতা এড়িয়ে গেছেন। “জোর যার মুল্লুক তার” এটাই জ্বলন্ত উদাহরণ। আওয়ামীলীগ সরকারের সবছে পহেলে বন্ধু মোদি সরকারও অনেকটা দ্বিমূখী আচরণ করেছে। নরেন্দ্র মোদি নিজেই সুচির হাতে হাত মিলিয়ে তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মতো বড় মাপের মানুষ হয়েও নরেন্দ্রমোদি রোহিঙ্গা জেনোসাইড নিয়ে টু-শব্দও করেননি। তাঁর পররাষ্ট্রনীতি যেন স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝেন না। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেই পালাম বিমান বন্দরে শেখ হাসিনাকে লালগালিচার সংবর্ধনায় প্রথা ও প্রটোকল ভেঙ্গে স্বাগত জানিয়ে দু’টি টুইট করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। টুইটে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। সম্পর্ক ভাল থাকার পরও বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাশার চেয়ে বেশী পাওয়ায় বন্ধু কৌশলে সুচির পক্ষ নিয়েছে। এমনকি রোহিঙ্গা গণহত্যাও নরেন্দ্র মোদিকে দংশন করেননি। তবে সু-সংবাদ হচ্ছে, সাম্প্রতিক ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশ মিয়ানমার সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াংসহ সামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইউরোপে আমন্ত্রণ স্থগিতসহ অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নে ব্যবহার করা যায় এমন সব অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি মিয়ানমারে বিক্রি নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে। তুরস্কের ফার্স্টলেডি এমিনি এরদোগান বিপন্ন রোহিঙ্গাদের দেখতে এসে প্রথম যে মানবতার ডাক দিয়েছিল, সেটা বিশ্ব স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাছাড়া মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদী ও জর্ডানের রানী রানিয়া আল আবদুল্লাহ রোহিঙ্গাদের দেখতে এসে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষনা দিয়েছে। বিশ্বনেতাদের সমীকরণ যাই হোক, এতে হতাশ হবার কোন কারণ নেই। জেনোসাইড কোন রাষ্ট্র, ধর্ম, জাতি বা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা। জেনোসাইড সমগ্র মানবজাতির বিকেককে দংশন করে। জেনোসাইড সম্পূর্ণ মানবাধিকারের বিষয় এবং মানবতাবিরোধী

লেখক: কলামিস্ট ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বাণী।
মোবাইল:- ০১৫৫৮৩৬৩৩৪৩,

অপরাধ। শুধু তাই নয়, জেনোসাইড পুরো মানবজাতিকে হত্যার সামিল। এখন করণীয় বিষয় হচ্ছে, জেনোসাইডকারীদের বিচারের দাবীসহ বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা অত্যাবশ্যক। রোহিঙ্গাদের জান-মালের নিরাপত্তা ও তাদের মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বব্যাপী অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবতার আওয়াজ তুলতে হলে ‘বিশ্ব নাগরিক সংঘ’ গঠনের বিকল্প নেই। তবে কাজটি মোটেও সহজ নয়। তবুও মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশের জনগণকেই শুরু করতে হবে। প্রত্যেক মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা পাব যেইদিন, সেদিনই হবে অশান্ত মন প্রশান্ত। আমার বিশ্বাস হবেই হবে একদিন ইনশা’আল্লাহ।