ক্যারিশমাটিক এক নায়কের গল্প ও কিছু স্মৃতি
॥ মো: আকতার হোছাইন কুতুবী ॥

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শুরু করছি, “আমি সেই অবহেলা, আমি সেই নতমুখ, নিরবে ফিরে যাওয়া অভিমান-ভেজা চোখ, আমাকে গ্রহণ করো। উৎসব থেকে ফিরে যাওয়া আমি সেই প্রত্যাখ্যান, আমি সেই অনিচ্ছা। নির্বাসন বুকে নেওয়া ঘোলাটে চাঁদ। আমাকে আর কি বেদনা দেখাবে?”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা, বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে। কবিগুরু আরো বলেন, “আমার মৃত্যুকালে তোমাকে যে-কথাটা বলিব মনে করিয়াছিলাম, আজ তাহা বলিতে ইচ্ছা করিতেছে। আজ মনে হইতেছে, তুমি আমাকে যত শাস্তি দাও-না কেন আমি বহন করিতে পারিব।”
কিছু মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারীÑএই প্রবাদটি যাদের জন্য, আনিসুল হক নিঃসন্দেহে সেই মানুষগুলোর অন্যতম, যারা স্বপ্ন বোনেন ও স্বপ্ন দেখান।
রবার্ট ফাস্ট বলেছিলেন, “যে সব দৃশ্য আমরা খুব মন লাগিয়ে দেখতে চাই সে সব দৃশ্য কখনো ভালভাবে দেখতে পারিনা সেই সব দৃশ্য অতি দ্রুত চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়।”
তেমনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন অলরাউন্ডার খ্যাত আনিসুল হক। ক্যারিশমাটিক মেধাবী নায়কের কিছু গল্প ও স্মৃতিচারণ করছি এই কারণেই বিবেকের তারণায় এবং ভালো লাগার মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।
আনিসুল হক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এক জ্বলন্ত প্রতিভা। ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর শৈশবের বেশ কিছু সময় কাটিয়েছেন নানার বাড়ি ফেনীতে। আব্বা ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। তার পিতার ৪ সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে ছিল উনার সংসার। নিজের ছোট সন্তানের ক্যাডেট কলেজের বেতন দিতে রীতিমত হিমশিম খেতেন। এমন সংগ্রামের সংসারেই আনিসুল হকের বেড়ে উঠা। স্কুল কলেজের গ-ি পেরিয়েছেন মফস্বল থেকে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধাবী আনিসুল হক ইকোনোমিক্সে স্নাতক করেন। তারপর বেশ কয় বছর বেকার ছিলেন। চাকরি খুঁজতেন পাশাপাশি বিটিভিতে কাজ করতেন। বিটিভিতে টুকটাক কাজ করার সুবাধে ২৫/২৬ বছর বয়সেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু জীবনের অনিশ্চয়তা দেখে তাঁর আব্বা তাঁকে ডেকে বললেন, আমি আমার পেনশনের টাকা থেকে কিছু টাকা তোমাকে দেবো। তুমি ঠিক করো তুমি কি করবে? আব্বাকে জানালেন, পাট এর ব্যবসা করতে চান। আব্বা পাটের ব্যবসার জন্য তাঁকে ষোল হাজার টাকা দিলেন। আনিসুল হক হিসাব করে দেখলেন এই টাকা দিয়ে দুই ট্রাক পাট কিনে সাপ্লাই দিতে পারলে বেশ ভাল লাভ করা যাবে। সেই হিসেব কষে পাট কিনতে চলে গেলেন টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে। পাট কেনার সময় স্থানীয় একজন বলছিলো, এখানে কিন্তু ট্রাক চুরি হয়ে যায়। এই শুনে আনিসুল হক ভাবলেন, আব্বার সারা জীবনের পেনশনের টাকা দিয়ে পাট কিনছেন। পাটের ট্রাক চুরি হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই তিনি উঠে বসলেন প্রথম ট্রাকে। রাত ১১টায় ট্রাক ছাড়লো। তিনি প্রথম ট্রাকের চালকের পাশে গিয়ে বসলেন। পিছনের ট্রাক সামনের ট্রাককে ফলো করে এগুতে থাকলো। রাত দুইটার দিকে মাঝপথে হটাৎ ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভার জানতে চাইলেন, স্যার প্রশ্রাব করবেন? আনিসুল হক কিছু বুঝে উঠার আগেই দরজা খুলে তাঁকে লাথি মেরে বাহিরে ফেলে দেয় ট্রাক চালক। দুই ট্রাক পাট সেদিন রাতেই চুরি হয়ে যায়। জীবনের প্রথম ব্যবসা শুরুর আগেই হোঁচট খেলেন। এই ঘটনার পর আব্বার কাছে গেলেন আনিসুল হক। তাকে আব্বা বললেন, তুমি ভাল করে চিন্তা করে দেখো তুমি কী করবে? আমার আরো কিছু টাকা আছে। আমি তোমাকে দিবো। এরপর ৪ বন্ধু মিলে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এক বন্ধু সদ্য বিয়ে করা বউয়ের গহনা বিক্রি করলেন, আরেকজন এক বছরের চাকরির জমানো টাকা দিলেন, অন্যজন আব্বার জমি বিক্রির টাকা আনলেন আর আনিসুল হক দিলেন আব্বার বাকি পেনশনের ৮৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৪ বন্ধু ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা জোগাড় করলেন। এরপর শুরু করলেন তাঁদের সংগ্রামের জীবন। ১৮০ ফুটের একটি রুমে ৩ বছর ধরে ব্যবসা চালিয়েছেন। আর এখন তিন বন্ধু মিলে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিককে কাজ দিয়েছেন। আনিসুল হক বিশ্বাস করতেন, স্বপ্ন মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। তাই তিনি স্বপ্ন দেখতেন এবং স্বপ্নের বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। সেই পরিশ্রম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে সফল করে তুলেছে।
আনিসুল হক মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, একটা মানুষের জীবনে মায়ের দোয়া এবং ছায়া অনেক বড় শক্তি। সব সময় মায়ের দোয়া নিয়েই পথ চলতেন। প্রায় শবে বরাতের রাতে মা’য়ের পায়ের নিচে শুয়ে আনিসুল হক মা কে বলতেন, মা তুমি আমার গায়ের উপর একটা পা রাখো আর আমাকে একটা ফুঁ দিয়ে দাও। মা তাঁর পাগল ছেলের আবদার রাখতেন। আনিসুল হকের মা আর ৮/১০ টা মায়ের মতো খুব শিক্ষিত ছিলেন না। তারপরও আনিসুল হক প্রতিটি পদক্ষেপে মায়ের দোয়া নিতেন। মায়ের আদেশ ও মতামত নিয়ে পথ চলতেন।
টেলিভিশনের উপস্থাপক হিসেবে আনিসুল হক ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। তার উপস্থাপনায় ‘আনন্দমেলা’ ও ‘অন্তরালে’ অনুষ্ঠান দুটি জনপ্রিয়তা শীর্ষে ছিল। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পূর্বে বিটিভিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুখোমুখি একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনাও করেছিলেন।
ব্যবসায়ী আনিসুল হক আশির দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৬ সালে তাঁর নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মোহাম্মদী গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রুপটির তৈরি পোশাক, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন, কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা রয়েছে। ২০০৭ অনুসারে, বস্ত্র ও পোশাক খাতে গ্রুপটি প্রায় ৭০০০ জন লোককে কর্মসংস্থনের ব্যবস্থা করেন।
আনিসুল হক ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালে বিজিএমই-এর সভাপতি, ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর নির্বাচিত সভাপতি, ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি, বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিআইপিপিএরও সভাপতিও ছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আনিসুল হক মেয়র নির্বাচিত হন। ক্যারিশমাটিক আনিসুল হক কারো নিকট মেয়র, আবার কারো নিকট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন আশির দশকের মানুষের নিকট একজন প্রাঞ্জল টিভি উপস্থাপক।
তিনি তার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিলেন রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও ‘স্মার্ট’ নগরী হিসেবে গড়ে তুলবেন। মেয়র নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নেয়ার পরই শুরু করেছিলেন সমাধান যাত্রা। তিনি বার বার বাঁধাপ্রাপ্ত হলেও রাজধানীর অনেকাংশেই বদলাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনি পেশীশক্তির রাজনীতিতে পা রাখেননি। নষ্ট রাজনীতির কাদা গায়েও লাগাননি। বরং রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করছেন, তাদের জন্যও ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মেয়র আনিসুল হক। তার চলে যাওয়ায় কাঁদছেন নগরবাসী। কাঁদছেন অরাজনৈতিক-রাজনৈতিক মঞ্চের মানুষেরাও। কাঁদবেইতো মানুষ! তিনি তো সবার কাছে সজ্জন, সাদা মনের প্রিয় মানুষ ছিলেন। আনিসুল হক এমন একটি নাম ভয়কে জয় করে উন্নয়নের মাঠ প্রসারিত করেছেন। যে দলের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে জিতলেন, উন্নয়ন প্রশ্নে সেই দলের মানুষেরাই পথ আগলে ধরেন। অবরুদ্ধও হলেন। তবে নিরাশ হননি। সব বাধা পায়ে মাড়িয়েই স্বস্তি দিতে চেয়েছিলেন নগরে। দৃঢ় মনোবল আর সাহসিকতা দিয়েই তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের রাস্তা দখলমুক্ত করেছিলেন। দায়িত্ব নেয়ার দুই বছরেই ঢাকা উত্তরের রূপ বদলে দেন। সততা আর সাহসিকতার জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে। তার প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল সিটি কর্পোরেশন কেন্দ্রিক টেন্ডার বাণিজ্য বন্ধ করে ক্রয় খাতে স্বচ্ছতা আনা। তাতে সক্ষমও হয়েছিলেন। আর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ, গাবতলীতে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা এবং সর্বশেষ দূতাবাসপাড়ায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা তার যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
মফস্বল থেকে উঠে আসা চৌকস আনিসুল হক আরও কিছু সফল পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে নগরীর সৌন্দর্যবর্ধন ও সবুজায়ন; উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ; সড়কবাতি স্থাপন, সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণ, সংস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা, জলাবদ্ধতা নিরসনে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নানা রংবেরঙের বিলবোর্ড সরানো ছিল যে কোনো মেয়রের জন্য চ্যালেঞ্জ। রাস্তার পাশে, ভবনের ছাদে কিংবা দেয়ালে হাজার হাজার বিলবোর্ড শহরের সৌন্দর্য ম্লান করে দিয়েছিল। সেই চিরচেনা রূপ বদলে দিয়েছিলেন আনিসুল হক। প্রায় ২০ হাজার বিলবোর্ড অপসারণ করেন তিনি। গাবতলী আর আমিনবাজারের অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ করে গতি দিয়েছিলেন এখানকার সড়কে।
আনিসুল হকের অল্প সময়ের মধ্যেই চলন্ত সিঁড়ি দেখতে পেয়েছিলেন রাজধানীবাসী। গত দুই বছরে দুটি চলন্ত সিঁড়িসহ ৫৫টি ফুট ওভারব্রিজ, দুটি আন্ডারপাস এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে। ১০টি উন্নতমানের আধুনিক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে, যা সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্যবহার করতে পারবে।
উন্নত নাগরিকসেবার জন্য ‘নগর’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ চালু হয়েছে তার সময়ই। নিরাপদ ঢাকা গড়ার প্রত্যয়ে এরই মধ্যে ৬৪২টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এতে জননিরাপত্তা বেড়েছে বহুগুণ। নগরবাসীর দুর্ভোগ কমাতে তার এলাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষ বাস সার্ভিস ‘ঢাকা চাকা’ চালু করেন। উত্তরায় ৩২ হাজার গাছের চারা রোপণ করেন। আরও ১০ লাখ গাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা চলছে।
আনিসুল হক ৬৬টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করেছিলেন, যেখান থেকে গড়ে প্রতিদিন দুই হাজার ৪০০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে সফলতার সিঁড়িতে হাঁটতে গিয়ে বারবার বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল মেয়র আনিসুল হককে। মোটেও সহজ ছিল না রাজনীতির আকাশে অরাজনীতিক এই ব্যক্তির কেতন উড়ানো। ‘ইচ্ছা থাকলেও নগরের উন্নয়ন করা যাচ্ছে না’ এমন অতৃপ্তির কথাও শুনিয়েছিলেন বারবার। তবুও থেমে থাকেননি। সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সহযোগিতাই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল বারবার। লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার তাড়া ছিল ঢাকায় ফিরে এসে আবারও নগরবাসীর জন্য কাজ শুরু করার। এত স্বপ্ন নিয়েও মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন হাস্যময়ী আনিসুল হক। তবে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তিনি চিরঞ্জীব হয়ে বেঁচে থাকবেন নগরবাসীর মাঝে। জীবনের পরিণতি হচ্ছে মৃত্যুকে আলিঙ্গন। দ্বিতীয় কোনো রাস্তা নেই। আজ এপারে, কাল ওপারে। বয়স যতই বাড়ছে, দু’পারেই জমছে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজন।
আমার হৃদয়ের কষ্টগুলোর অনুভূতি হচ্ছে ঢাকাবাসী এমন একজনকে হারালেন, যিনি স্বপ্নে বিভোর ছিলেন ‘স্মার্ট ঢাকা’ গড়ে তুলতে। খুব বড় জীবন পাননি তিনি। কিন্তু অসাধারণ কাজ দিয়ে এপারে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। দেশের সবচেয়ে আধুনিক জনপ্রিয় উপস্থাপকের আসনটি দখল করা আনিসুল হক। স্মৃতির আঙ্গিনায় রাখার মতো আনিসুল হক আপনি শান্তিতে থাকেন! আল্লাহ্ যেন আপনাকে জান্নাতবাসী করেন এবং আপনার স্বজনদের এই শোক বইবার ক্ষমতা দেন-এই কামনা।
আনিসুল হকের মৃত্যুর পর তার ছেলে নাভিদুল হক ফেইস বুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন তার সাথে ছোটবেলার খুব বেশি স্মৃতি নেই। কারণ আমার বাবা ব্যবসা এবং পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন সুশীল সমাজের একজন সক্রিয় সদস্য এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আমি যত বড় হতে থাকলাম আমাদের বন্ধন আরও শক্ত হতে থাকল। তিনি ছিলেন আমার পরামর্শদাতা, আমার সঙ্গী, আমার বস এবং আমার পথনির্দেশক। গত কয়েক বছর আমরা দুজন মিলে আমাদের সেরা সময়টুকু কাটিয়েছি। তিনি যখন ডিএনসিসি মেয়র হিসেবে প্রার্থী হয়েছিলেন তখন আমি তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। তিনি আমার কাছে তার পরবর্তী পদক্ষেপ পরিকল্পনা এবং স্বপ্নগুলো জানাতেন।
বাবাকে নিয়ে আরও বিস্তারিত লেখার আশাবাদব্যক্ত করে তিনি লিখেন, আমি অবশ্যই তাকে নিয়ে আরও লিখব। তার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানাব আপনাদের। আমি আপনাদের বলতে পারি, তিনি আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গুণগুলো বন্টন করেছেন। সততা দিয়ে তিনি কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। যারা তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন তারা যথেষ্ট ভাগ্যবান ছিলেন। কারণ যারা তার সাথে সময় কাটিয়েছে, তার কথা, হাসি, উচ্চারণ, কবিতা তাদের স্পর্শ করেছে এবং সেসব স্মৃতি তাদের চিরকাল মনে থাকবে।
‘তিনি সব সময় বলতেন মেয়র না থাকলেও মানুষ যাতে তাকে মনে রাখে। আব্বু, যখন তুমি বেহেশত থেকে তাকাবে, তখন দেখবে লাখ লাখ মানুষ তোমাকে মনে করছে। আমি তোমাকে প্রতিদিন অনুভব করব। আমি অনেক ভাগ্যবান তোমার মতো একজন কিংবদন্তিকে বাবা হিসেবে পেয়ে’। ফেসবুক স্ট্যাটাসদাতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যারা আমার বাবার স্মরণে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাদের লেখা দেখে আমি কেঁদেছি। আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
উল্লেখ্য, তৈরি পোশাক ব্যবসায় নিজের অবস্থার বদল ঘটিয়েছিলেন আনিসুল হক। ঢাকার অবস্থাও বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসির) মেয়রের চেয়ারে বসেন, কিন্তু তার সেই স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল। লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৬৫ বছর বয়সী আনিসুল হক। যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০.২৩ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন)
আনিসুল হক সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিসে (মস্তিষ্কের রক্তনালির এক ধরনের প্রদাহ) আক্রান্ত হয়ে সেন্ট্রাল লন্ডনের ইউস্টনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আপনি আমাদের ছেড়ে সত্যি সত্যিই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। পরিশেষে এটুকুই বলব, গত বছরে আপনার দেওয়া একটা স্মৃতি, যে স্মৃতি আমি কখনো ভুলতে পারবো না। আমার কানে আপনার সেই কথাগুলো আজও বেজে ওঠে। মে মাসে ব্র্যান্ড ফোরামের আয়োজনে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে তরুণদের সমাবেশে আপনি বলেছিলেন, “আমার জীবনটা শুরু হয়েছিল, একটা অগস্ত্যযাত্রার মতো। এ এক অন্তহীন পথে ছুটে চলা”। আরো বলেছিলেন, “লাইফ ইজ আ ট্রিপ,” ওই ট্রিপে কোনো ম্যাপ নেই। এই ম্যাপ নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়। আমাদের কার কতটুকু টাকা আছে, ওটি একটি অংকের হিসাব। কিন্তু তার কতুটুকু সময় আছে? জীবনের কোন পথ পর্যন্ত পেরোনোর জন্য বিধাতা লিখে রেখেছেন, আমি জানি না। সময়ের হিসাব আমরা জানি না। সময়ের হিসাব আসলেই কেউ জানে না। আপনি এখন সময়ের বহু ঊর্ধ্বে। ভালো থাকবেন আনিসুল হক। বিদায় হে নায়ক বিদায়!!!

মুক্ত আলোচনায়: মো: আকতার হোছাইন কুতুবী, সহ-সম্পাদক জাতীয় দৈনিক আমার কাগজ, দি গুডমর্নিং ও প্রধান সম্পাদক জাতীয় ম্যাগাজিন জনতার কণ্ঠ এবং উপদেষ্টা সম্পাদক জাতির আলো, ঢাকা। akterkutubinews@gmail.com Mobile : 01822858400