স্বপন ধর

নয়ন-ভোলানো ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ, বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে কত অপরূপ শোভা! সেই শোভা দেখতে দেখতে এদেশের মানুষ হয়েছে ভাবুক, কবি-শিল্পী। তাঁদের কবিতা, গান ও শিল্পকর্মে রয়েছে প্রকৃতির বন্দনা। সত্যি ‘ধন-ধান্য পুষ্প ভরা’ এদেশ। এদেশ প্রকৃতির দান। পাহাড় থেকে সাগর; বন থেকে বাদাড়ে, বৈচিত্র্যের যতসব খেলা। ঋতুর কল্যাণেই এসব হয়ে থাকে। হেমন্ত তেমনই এক ঋতু। বর্ষা শেষ হয়ে কাশ-শিউলি ফোটা শরতের পরে আসে হেমন্ত। কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাসে এর পরিচয়। সারা প্রকৃতি জুড়ে আসে সোনালি ধানের আগমনী সংবাদ। ধানের মৌ মৌ সৌরভে প্রকৃতি সোনালি চাদর বিছিয়ে দেয় তখন। তাতে কার্ত্তিকের অনটন যায় কেটে। ধানের উত্সবে মাতে পাড়া। কৃষকেরা তখন ধান কাটায় ব্যস্ত। মনে পড়ে কবিগুরুর ‘সোনারতরী’ কবিতার কথা—‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী/ আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি।’ এমনই সোনার ধান গোলায় ভরে কৃষকেরা হয়ে ওঠে সচ্ছল। নতুন ধানের আনন্দ আমাদের আমোদিত করে। সে ধানের চালেই শীতে হয় পৌষপার্বণ। চলে পিঠে-পুলির উত্সব।

সেই উত্সব দেখে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন—‘নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রান হলো মাত্।’ আর কবিগুরু লিখেছিলেন—‘ভরাক্ষেতে মধুর হাসি’র কথা। সে কথা যেন ফুরোতেই চায় না।

প্রকৃতির এই প্রাচুর্যে জলবায়ু অনেকটাই নাতিশীতোষ্ণ হয়ে ওঠে। জীবন হয় প্রশান্তিময়। কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু এটি। তিনি বলেন, ‘আমি অঘ্রানেরে ভালোবাসি/ বিকেলের এই রং’। সত্যি বলতে—বিকেলের সোনারোদ কার না ভালো লাগে? এই ভালো লাগার ঋতু, বছরে একবার করে এসে শিশুমনেও দোলা দিয়ে যায়। ভালো লাগে শান্ত নদীতে নৌকায় বেড়াতে। ভালো লাগে পাখির ডাক। রবিশস্যের তৈরি মাঠ। বিকেলে বেড়ানো কিংবা বৌচি খেলা।

বর্ষার জল, শরতের বাংলাদেশকে জলমগ্ন করে রাখে। হেমন্তে সে-সব ভেসে ওঠে। বন্যা শেষে পলিতে পলিতে ভূমিতে আসে ফসলের বন্যা। শাক-সবজি ফল-মূলে সে অন্য এক বাংলাদেশ। সোনালি ধানের সাথে সবুজের সমারোহ হয় তখন। গোলাপ-জুঁইসহ রং-বেরঙের ফুল ফোটে। ফুল ও ফসলের গন্ধ, নতুন মাটির সৌরভ, দিগন্ত
বিস্তৃত ফসলের মাঠ, নির্মল বাতাস, শুভ্র আকাশ, ঝরঝরে প্রকৃতির জন্য হেমন্ত এক লোভনীয় ঋতু।

হেমন্তের শেষ সময়টা শীতের আগমনবার্তা নিয়ে আসে। এমন মঙ্গলময় মুহূর্তে যেন কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র-ছায়ায় লুকোচুরি খেলারে ভাই, লুকোচুরি খেলা।’ সেই খেলাতেই কাটে সোনাঝরা হেমন্তবেলা। আর সেই বেলায় আমাদের মনে আসে আনন্দ। দেহে আসে অফুরন্ত শক্তি। তখন প্রকৃতিতে, জলে-স্থলে-বনে-আকাশে এক অপরূপ রূপের মাধুর্য দেখা দেয়। নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলায় মন চায় তখন উড়তে। শিশিরের আগমনে, শিউলিঝরা শেষ করে হেমন্ত আসে, অন্তে ‘হেম’ (সোনা) নিয়ে। তার মুগ্ধ পেলবতা, শিশির সকাল, কড়কড়ে দুপুর, উদাস বিকেল, আবির রাগের সন্ধ্যা; সবাইকে অভিবাদন জানায়। আর এসব দেখতে দেখতে আমাদেরও মন যেন কেমন কেমন করে; এই হেমন্তে। তাই হেমন্তকে আমরা কবি জীবনানন্দের মতোই ভালোবাসি…।