কায়সার হামিদ মানিক,উখিয়া :
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও চলতি বছরের ২৫ আগস্টের পরে যে সমস্ত রোহিঙ্গা মিয়ানমার জান্তা কর্তৃক জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ওইসব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া হবে।
প্রত্যাবাসন চুক্তিতে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়ার ফলে স্বদেশে ফেরার অনিশ্চিতার দোলাচলে ভুগছে নতুন করে আসা প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা আরো ৩ লাখের অধিক রোহিঙ্গার বিষয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে সম্পাদিত চুক্তিতে উল্লেখ্য করা হলেও তাদেরকে কবে, কখন, কিভাবে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা আসেনি। যার ফলে প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ও হতাশা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ঢাকা-নেপিডো স্বাক্ষরিত ১৯ দফা চুক্তি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। চুক্তির শুরুতেই সেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে বাস্তুচ্যুতদের মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসংঙ্গে জানতে চাওয়া হলে ১৯৯২ সালে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিক ডাক্তার জাফর আলম ডিপো জানান, এখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মাঝে সরকারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের দাবি তাদেরকে মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান পূর্বক নাগরিকত্ব প্রদান করতে হবে। তাহলে সমস্ত রোহিঙ্গা সেচ্ছায় স্বদেশে ফিরে যেতে সম্মত হবে।
কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক জানান, রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখনো পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়নি। দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী ৭ লাখ রোহিঙ্গা যদি মিয়ানমারে চলে যেতে সক্ষম হয় তাহলে বাকী ৩ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থা কি হবে তা নিয়ে ওই বাকি রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা।
বালুখালী ক্যাম্পের হেড মাঝি আবু তাহেরের সাথে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে সে জানান, নতুন করে আসা প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে সম্পাদিত চুক্তিতে যে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে ওইসব শর্ত সাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া প্রক্রিয়া শুরু করলেও তা কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে মিয়ানমারে অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখার ব্যাপারটা মানতে পারছেন না তারা। নিজের বসতভিটায় ফিরে আবারো নতুন জীবন শুরুর পাশাপাশি তাদের সহায়-সম্পত্তি ফিরে চান গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গারা।
বালুখালী ১নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সর্দার লালু মাঝি জানান, মিয়ানমার থেকে যেসব রোহিঙ্গা পালিয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের অধিকাংশই এক কাপড়ে এসেছে। তাই রোহিঙ্গাদের কাছে মিয়ানমারের কোন বৈধ সনদ বা কাগজপত্র থাকার কোনো প্রশ্নই আসেনা। কারণ তাদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পাদিত প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুসারে যে সব শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী মুষ্টিমেয় রোহিঙ্গা ছাড়া বেশির ভাগ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আওতায় আসবেনা। এমতাবস্থায় সরকারের চুক্তি কতটুকু ফলপ্রসু হয় তা নিয়ে রোহিঙ্গারা উদ্বিগ্ন। তবে শর্ত ছাড়া মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে রোহিঙ্গারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রথম পালিয়ে আসে ১৯৭৮ সালে। তখন তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর অধীনে ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে গিয়েছিল। ১৯৯২ সালে আবারো দলে দলে এদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। ওই সময় তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আরেকটি সমঝোতা হয়। এর অধীনে ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে যায় মিয়ানমারে। ২০১২ সালে রাখাইনে জাতিগত দাঙ্গা এবং ২০১৬’র অক্টোবর ও এ বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ছাড়িয়ে গেছে ১০ লাখ।
উখিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, চুক্তিতে যে সমস্ত শর্ত সাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে তাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আদৌ বাস্তবায়ন হয় কি না তা দেখার বিষয়।