জসিম মাহমুদ, টেকনাফ:

পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গারা অনেকেই তাদের নির্ধারিত শিবিরে যাচ্ছেনা। এরা যে যার মতো করে যেখানে খোলা জায়গা পাচ্ছে সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। যেসব এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকে পড়ছে তারা সেই এলাকায় থেকে যাচ্ছে। এমনকি আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত ব্যক্তিদের আশ্রয়ে থেকে যাচ্ছে অনেকে। আবার কেউ কেউ সুযোগমতো কক্সবাজারের বাইরেও চলে যাচ্ছে।

দুপুর হলে পাহাড়ের সুবজ ঘাসের পিঠে যেখানে শিশুদের মিলন মেলা বসে, তাঁরা কেউ ফুটবল আবার কেউ ক্রিকেট বেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তো সেখানে। আর সেই পাহাড় তীরে খোলা আকাশের নিচে নতুন করে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের পলিথিনের ঝুপড়ি ছাউনির ঘর।

শুক্রবার দুপুরে কক্সবাজার-টেকনাফ প্রধান সড়কের পাশে পশ্চিমে হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরা নামক এলাকায় পাহাড় তীরে এমন দৃশ্যমান চোখে পড়ে। সেখানে রয়েছে স্থানীয়দের চারটি ছোট দোকান। যারা রোহিঙ্গাদের মালামাল বিক্রি করে থাকে। এমন এক দোকানকার নুর আমিনের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানান, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এ পাহাড়ের তীরে নতুন করে বসতি গড়ে তুলেছে। তিনি দৈনিক পাচঁ হাজার টাকার বেশি বিভিন্ন মালামাল বিক্রি করে থাকে। গত এক সপ্তাহে আগেও সেখানে স্থানীয় শিশুরা খেলাধুলা করতো , কিন্তু হঠাৎ করে রোহিঙ্গা এসে পলিথিনের ঘর নির্মাণ শুরু করে। কেউ তাদের বাধা দিচ্ছেনা। এ খোলা জায়গার এক পাশে সরকারি পাহাড় অন্য পাশে রয়েছে মালিকানাধীন জোট জমি। ইতি মধ্যে সম্পতি পাহাড়ের উভয় পাশে প্রায় শতাধিকের মতো ঘর করেছে রোহিঙ্গারা। এর মধ্যে আবার দুইটি বক্লে ভাগ করা হয়েছে, প্রতি বক্লে একটি করে মাঝি রয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার এসে জাদিমুরা পাহাড়ের পাশে ঘর নিমার্ণ করেছিল মো. ইসমাইল নামে এক রোহিঙ্গা। তার বাড়ি মিয়ানমারের মংডু ইতিলিয়া পাড়া গ্রামে। তিনি জানান, গত এক মাস আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নির্যাতনের মুখে পড়ে প্রাণে বাচঁতে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি। এরপর বেশ কয়েকদিন শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পাড়ার সমুদ্র তীরে ছলিম উল্লাহ নামে এক ব্যাক্তির বাড়িতে আশ্রয় নিয়। কিন্তু ওই বাড়ির মালিক অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে বললে, সেখান থেকে লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে এক পরিচিতি লোকের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে আমাদের থাই হয়নি। অবশেষে এই খোলা জায়গায় দেখে অন্যদের মতো একটি পলিথিনের ছোট্র ঝুপড়ির ঘর নির্মাণ করি। উখিয়ায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় যাচ্ছেনা কেন জানতে চাইলে, জবাবে তাদের আগে পালিয়ে আসা তার চাচাতো ভাই খোরশেদ আলম পরিবার নিয়ে উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তার মাধ্যমে জেনেছি সেখানে থাকার মতো কোন জায়গায় নেই, যে জায়গাগুলো রয়েছে সেখানে পায়খানার গন্ধের জন্য থাকা অবস্থা নেই। তাই সেখানে না গিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। এখানে ঘর নিমার্ণ করার সময় কেউ বাধা প্রদান না করলেও এখন জায়গার মালিক দাবিদার স্থানীয় সব্বির আহমেদ তার ভাই মোহাম্মদ ইলিয়াছ প্রতিমাসে তাদের কাছ থেকে ৪০০ টাকা করে দাবি করে আসছে।

তবে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা দাবি করার কথা অস্বীকার করেছেন সব্বির আহমেদ তার ভাই মোহাম্মদ ইলিয়াছ। তারা জানিয়েছেন, হঠাৎ রোহিঙ্গারা এসে আমাদের জায়গাতে ঘর নিমার্ণ করছে। মানবিক কারণে তাদেরকে আমরা বাধা দেয়নি। এমনকি পাশে সরকারি পাহাড় কেটেও রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছে।

জাদিমুড়া নতুন রোহিঙ্গা বসতির মাঝি একরাম উল্লাহ বলেন, এ জায়াগায় প্রায় শতাধিক ঘরে ৫ শতাধিক মানুষ রয়েছে। এ বস্তির মানুষ খাবার, পানি, চিকিৎসা ও টয়লেট নিয়ে খুবই কষ্টে রয়েছি। আমাদের মতো নতুন অনুপ্রবেশকারিরা কোথাও জায়গা না পেয়ে এ বস্তিতে এসে আশ্রয় খোজঁছেন।

জাদিমুড়ার থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে গেলেই টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবির। মূল সড়ক থেকে পশ্চিমে দিকে প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে শিবিরটির অবস্থান। শিবিরের ঢুকলে চোখে পড়ে হাজার হাজার মানুষের ঢল। কে কোথায় যাচ্ছে আর কে কোথায় থেকে আসছে তা বলা খুবই মুশকিল। এত মানুষের ¯্রােত নিয়ন্ত্রণ করা আদৌ কারও পক্ষে যে সম্ভব নয়, তা সহজেই ধারনা করা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় ইউপি সদস্য বলেছেন, উখিয়া-টেকনাফের প্রতিটি সড়কে পুলিশ-বিজিবি ও সাদা পোশাকধারীদের কড়া নজরদারি তবুও কৌশলে ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। কোন মতো তাদের এক জায়গায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। তবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ১৪ নভেম্বর জেলা প্রশাসনের একটি দল টেকনাফে অভিযান চালিয়ে ১১জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছিল। এর মধ্যে ছয় শিশু, তিননারী ও দু’জন পুরুষ ছিল। পরে তাদেরকে উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইন উদ্দিন খান জানান, রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় রাখতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। রোহিঙ্গারা দালাল চক্রের সহযোগিতায় ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টাকালে প্রায় ৫ হাজার শরণার্থীকে ক্যাম্পে ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। তিনি আরও জানান, যেসব রোহিঙ্গা শিবিরের বাইরে আশ্রয় নিয়েছে বা বসতি করছে, তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করে উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে ফেরত পাঠানো হবে। তাছাড়া প্রধান সড়ক ছাড়াও সীমান্তের গ্রামগুলোর হাঁটা রাস্তা দিয়ে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দিকে চলে যায়। সব পক্ষ থেকে সহযোগিতা না পেলে তাদের এক জায়গায় রাখা খুব কষ্ট হয়ে দাড়াবে।

রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার নিধারিত স্থান টিক করলেও পাহাড়, বনাঞ্চল উজাড় করে টেকনাফের মৌচনি, দমদমিয়া, জাদিমুরা, মিঠাপানিরছড়া, রাজারছড়া, রোজারঘোনা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, লেচুয়াপ্রাং, পানখালী, সিকদারপাড়া, মিনাবাজার, লম্বাঘোনা, আমতলী, নোয়াখালী, কচ্চপিয়া, বড়ডেইল, হলবনিয়া, শামলাপুর, নেচার পার্ক, বাহারছড়া ও মেরিন ড্রাইভ এলাকার রোহিঙ্গারা ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে। রোহিঙ্গাদের সবাই যে হতদরিদ্র, তা নয়। অবস্থাসম্পন্ন লোকও আছেন। তাঁরা পূর্বপরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে টেকনাফ-কক্সবাজার বা আশপাশে বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে উঠছে। আবার অনেকে চলে যাচ্ছেন চট্টগ্রামে। পৌরসভায় বাড়ি ভাড়া আশ্রয় নেওয়া আবদুল গফুর নামের এক রোহিঙ্গা বলেন, তারা প্রথমে টেকনাফ দিয়ে ঢুকে উখিয়া কুতুপালং আশ্রয় নেন। এরপর সেখানে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করে দালালের মাধ্যমে টেকনাফ এক বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতা দিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে পাঠানো হচ্ছে, যাতে তারা অন্য কোথাও ছড়িয়ে যেতে না পারে। তবুও কিছু রোহিঙ্গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদেরকে নির্ধারিত জায়গায় রাখতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, বর্তমানে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তারা আশ্রয় শিবিরে না গিয়ে পাহাড় ও বনে জায়গায় দখল করে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে বসবাস করছে। তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করে তাদের নির্ধারিত আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে বনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে যা পূরণ করা অসম্ভব।’