ডেস্ক নিউজ:
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সময় নির্দিষ্টকরণ চুক্তি করতে চায় বাংলাদেশ। আগামীকাল বুধবার (২২ নভেম্বর) পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে এবং পরদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে গত সোমবার তার দফতরে বলেন, ‘আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এরমধ্যে একাধিকবার দুই দেশের মধ্যে প্রস্তাব-পাল্টা প্রস্তাব চালাচালি হয়েছে। দেখা যাক সামনে কী হয়।’

সরকারের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুই দেশের মধ্যে জোরেশোরেই দরকষাকষি চলছে। এখন পর্যন্ত ছয় বার প্রস্তাব-পাল্টা প্রস্তাব চালাচালি হয়েছে দুইপক্ষের মধ্যে।

তিনি আরও বলেন, আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চাই একটি সময় নির্দিষ্টকরণ চুক্তি করতে। এটি নিয়ে দুইপক্ষ কথা বলছে। কয়েকটি বিষয়ে দুইপক্ষের মধ্যে মতবিরোধ আছে। সেটিকে কমিয়ে আনার জন্য আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।

ওই কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা খারাপ, কারণ ১৯৯২ সালের সমঝোতায় কোনও সময় উল্লেখ না থাকায় তারা ২০০৫ সাল পর্যন্ত মাত্র দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়েছিল। অন্যদিকে, ১৯৭৮ সালে প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছিল ছয় মাস মেয়াদি। ওই সময়ের মধ্যে দুই লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত গিয়েছিল।

গত মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল মিয়ানমার সফর করেন। সেখানে দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার বৈঠকে দুই পক্ষ ১০ দফা প্রস্তাবে সম্মত হয়। কিন্তু একদিন পরই মিয়ানমার তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এককভাবে নিজেদের মতো করে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, যাতে বৈঠকের কিছু সিদ্ধান্ত বাদ দেওয়া হয়।

এ ঘটনার উল্লেখ করে ঢাকার এই কর্মকর্তা বলেন, এই কারণে আমরা যে চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছি, সেখানে প্রতিটি জিনিস সংযুক্ত করতে চাইছি, যাতে পরে মিয়ানমার অন্য কোনও কথা বলতে না পারে।

প্রস্তাব চালাচালির বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথম প্রস্তাব দেওয়া হয় ২৩ সেপ্টেম্বর। মিয়ানমারের ইউনিয়ন মন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় ২ অক্টোবর আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়।

মিয়ানমার ২০ অক্টোবর এর জবাব দিলে বাংলাদেশ ২ নভেম্বর পাল্টা প্রস্তাব দেয়। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৬ নভেম্বর পাল্টা প্রস্তাব দেওয়া হলে বাংলাদেশ দুদিন পর তার জবাব দেয়।

মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি চুক্তি করতে চায় বাংলাদেশ। এই চুক্তি স্বাক্ষরের দুই সপ্তাহের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন ও এর কার্যপরিধি ঠিক করা হবে।

এটি গঠিত হওয়ার একমাসের মধ্যে মাঠপর্যায়ে ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টের জন্য একটি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হবে।

এই ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টে বিস্তারিত লেখা থাকবে প্রতিদিন কতজন করে রোহিঙ্গা ফেরত যাবে, কোন সীমান্ত পথ দিয়ে যাবে, রাখাইনে তারা কোথায় অবস্থান করবে, যাওয়ার সময় তাদের যে ফরম পূরণ করতে সেটি কী ধরনের হবে ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়গুলো।

সরকারের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী ২২ ও ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারে দ্বিপক্ষীয় সফর করবেন এবং আমরা আশা করছি সেখানে আমরা একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি করতে সক্ষম হবো।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের মিয়ানমার সফরের সময়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার জন্য ৩০ নভেম্বরের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে।

বাংলাদেশের পক্ষে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপে নেতৃত্ব দিতে পররাষ্ট্র সচিবের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে।

মতবিরোধ বিষয়গুলো

মিয়ানমার চায় দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার পর বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোনও দেনদরবার করবে না।

এ বিষয়ে সরকারের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে আমাদের অভিমত হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং বহুপাক্ষিক যোগাযোগ এক বিষয় নয়।

মিয়ানমার চায়– ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর যেসব রোহিঙ্গা এসেছে শুধুমাত্র তাদের ফেরত নেবে তারা। এর বিপরীতে বাংলাদেশ চায় ১৯৯২ সাল থেকে যারা এসেছে তাদের সবাইকে ফেরত পাঠাতে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস দমনপীড়নের মুখে ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবর থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। তারও আগে থেকে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল।

মিয়ানমার জাতিসংঘের কোনও সংস্থাকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে চায় না কিন্তু বাংলাদেশ চায় এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওই সংস্থাগুলো যুক্ত থাকুক।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ১৯৯২ সালের সমঝোতার অধীনে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সঙ্গে ১৯৯৩ সালে একটি চুক্তি হয়, যার মাধ্যমে ওই সংস্থা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনুমোদন করতো। এখন তারা যদি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে না থাকে তবে জটিলতা তৈরি হতে পারে।

বাংলাদেশের প্রস্তাবে ছিল বাংলাদেশের তথ্য এবং মিয়ানমারের তথ্যের মধ্যে অমিল হলে যৌথ যাচাই বাছাই হবে। কিন্তু মিয়ানমার এখনও এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি।