প্রভাষ আমিন

চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট মিয়ানমারের সৃষ্ট। মানবিকতার কারণে বাংলাদেশ প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এখন এই সমস্যা মিয়ানমারকেই সমাধান করতে হবে। কিন্তু আসল সমস্যা হলো, মিয়ানমার এই সমস্যা স্বীকারই করে না। তাই মিয়ানমারকে সমস্যা স্বীকার এবং সমাধানে বাধ্য করতে হবে। আর সেই বাধ্য করতে চাই কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ। অনেক আগেই এটা পরিস্কার দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এই সমস্যা সমাধান হবে না।

.

ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের সসম্মানে ফিরিয়ে নেয়া এবং নাগরিকত্ব দেয়ার আহবান জানিয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ চাপটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর। গত ১৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে ‘মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ নিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। ওআইসির এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছে সৌদি আরব। প্রস্তাবটি নিয়ে আগামী ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে চূড়ান্ত ভোট হবে। থার্ড কমিটিতে পাশ হওয়া প্রস্তাবে রাখাইনে সেনা অভিযান বন্ধের পাশাপাশি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদের অবাধে সেখানে যাওয়া নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ বাসভূমিতে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরাটা নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত পরিচালনা, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্যদের চলাফেরা, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশ হওয়া প্রস্তাবে মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন পর্যালোচনা করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে।

এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের মহাসচিবকে মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যিনি সব রোহিঙ্গার প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন। জাতিসংঘের থার্ড কমিটিতে পাশ হওয়া এই প্রস্তাব নিয়ে অত আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। কারণ এর আগেও অনেকেই সমস্যা সমাধানের অনেকগুলো পথ বাতলে দিয়েছিলেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫ দফায়ও সমাধানসূত্র ছিল। সবচেয়ে ভালো সমাধান তো দিয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান তার কমিশনের রিপোর্টেই। কিন্তু মিয়ানমার সেইসব চাপ বা সুপারিশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এসেছে বরাবর। তবুও এবার জাতিসংঘের থার্ড কমিটিতে পাশ হওয়া এই প্রস্তাব নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে। আর এই আশার সূত্র হলো এর সংখ্যাধিক্য।

থার্ড কমিটিতে ভোটাভুটিতে অংশ নেয় মোট ১৭১টি রাষ্ট্র। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ১৩৫টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। আর চীন, রাশিয়াসহ ১০টি দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে ভারতসহ ২৬টি দেশ।

ভারত ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানও ভোট দেয়নি। আর ২২টি দেশ ভোটাভুটি অনুষ্ঠানে যায়নি। মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে এর আগেও ভোটাভুটি হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারকে কখনোই এমন বিপুল ভোটের চাপে পড়তে হয়নি। এবারই পক্ষে ভোট পডেছে সবচেয়ে বেশি, ১৩৫টি। এবারই বিপক্ষে ভোট পডেছে সবচেয়ে কম, ১০টি। এবারই ভোট দানে বিরত থেকেছে সবচেয়ে কম, ২৬টি দেশ।

এছাড়া এবারই প্রথম কিউবা, ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়ার মত দেশ মিয়ানমারের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। যারা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে বা ভোট দানে বিরত ছিল, তারা রোহিঙ্গা নির্যাতন বা মিয়ানমারের পক্ষে তেমনটি নয়। বরং সবাই রোহিঙ্গা নির্যাতনের নিন্দা করেছে। বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।

পাশ হওয়া এই প্রস্তাবের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু ১৩৫টি দেশ যে প্রস্তাবের পক্ষে, তা উড়িয়ে দেয়া অত সহজ নয়। এই প্রস্তাবের নৈতিক জোরটা অনেক বেশি। তাছাড়া এই বিপুল সংখ্যাধিক্য আরেকটা বিষয় নিশ্চিত করেছে। আগামী ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে চূড়ান্ত ভোটেও প্রস্তাবটির পাশ হওয়া।

২০১১ সালে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এ ধরনের আরেকটি প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। তখন পক্ষে ভোট পড়েছিল ৯৮টি, বিপক্ষে ২৫টি আর বিরত ছিল ৬৩টি দেশ। তার মানে এই সময়ে আরো অনেকগুলো দেশ মিয়ানমার পরিস্থিতির বাস্তবতা উপলব্ধি করেছে। তবে তারপরও অনেকে বলছেন, কেন ১০টি দেশ বিপক্ষে ভোট দিল, কেন ২৬টি দেশ বিরত থাকলো।

তার মানে বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থ। যদিও এই প্রস্তাবে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ নয়, তবুও ১৩৫টি দেশের মিয়ানমারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়াকে অনেকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য বলেই মানছেন। আরেকটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন হলেও একটি নির্দিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে কারো কারো আপত্তি আছে। চীন বা রাশিয়া কান্ট্রি স্পেসিফিক কোনো রেজুলেশনে এ পর্যন্ত পক্ষে ভোট দেয়নি।

ভারত এর আগে বিপক্ষে ভোট দিলেও এবার বিরত থেকেছে। চীনের বিপক্ষে ভোট দেয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অনেকেই জানেন মিয়ানমারের সাথে চীনের স্বার্থের সম্পৃক্ততা্ অনেক বেশি। তবে ভারতের বিরত থাকা নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে। কয়েকদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরকালে বলেছিলেন, ‘পড়শি পেহলে, লেকিন বাংলাদেশ সবচে পেহলে।’

শুনতে খুব ভালো লেগেছে। আমরা আশ্বস্তও হয়েছিলাম। গত সপ্তাহে এক টেলি কনফারেন্সে বিভিন্ন প্রকল্প উদ্বোধনকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বের ঘোষণা দিয়েছেন উঁচু গলায়। কিন্তু প্রয়োজনের সময় চুপ করে থাকে এমন ‘সাবসে পেহলে’ বন্ধু লইয়া আমরা কী করিবো? এটা ঠিক ভারত তার স্বার্থটাই বিবেচনা করবে সবার আগে।

কিন্তু ভারতকে বুঝতে হবে, নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের স্বার্থের সাথে তাদের স্বার্থটাও জড়িত ওতপ্রোতভাবে। ভারত যদি ভেবে থাকে, তারা নিরব থেকে মিয়ানমারের সাথে চীনের সম্পর্কে ভাগ বসাবে, আর তাদের নিরবতায় বাংলাদেশও নিরব থাকবে; তাহলে ভুল হবে সেটা। বাংলাদেশকে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে। ভারতকে বুঝিয়ে দিতে হবে, মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশকে তার বেশি দরকার।

আমরা যদি শুধু বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে বসে থাকি, তাহলে ভারত আমাদের কিছু দেবে না, খালি নেবে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে সুষমা স্বরাজের একটি উক্তিকে আমি বেসলাইন মানি। সীমান্ত চূক্তি পাশের সময় সুষমা স্বরাজ তাদের পার্লামেন্টে বলেছিলেন, বিগ ব্রাদার না হয়ে এলডার ব্রাদার হতে হবে। ঠিক এই সূত্রটাই মানতে হবে। তুমি যদি আমার বন্ধু হও, এলডার ব্রাদার হও; আমি তোমাকে সম্মান করবো, ভালোবাসবো। আর যদি বিগ ব্রাদার হয়ে দাদাগিরি ফলাও; তাহলে আমরা তোমাদের সাথে নেই।

আমাদেরও বুঝিয়ে দিতে হবে, সম্পর্কটা একতরফা নয়; পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাসে, দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের নিরিখেই এগুবে সম্পর্ক। বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মানুষের কমতি নেই। অনেকে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, তাই ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু করলে তীব্র প্রতিবাদ করেন।

কিন্তু অনেকের ভারতবিরোধিতার উৎস পাকিস্তান প্রেম। ভারতকে গালি দেয়ার একটা সুযোগ পেলে তাদের মনে ঈদ লেগে যায়। এই যেমন জাতিসংঘের থার্ড কমিটির এই ভোটাভুটিতে ভারত ভোটদানে বিরত ছিল বলে এই মহলটির উল্লাসে কান পাতা দায়। তাদের গলা আরো বড় কারণ পাকিস্তান প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে।

তুলনাটা এমন যেন পাকিস্তান আমাদের পরম বন্ধু। হা হা হা। পাকিস্তানপ্রেমী বন্ধুরা, আপনার মনে যতই পাকিস্তান প্রেম থাকুক, পাকিস্তান কখনোই বাংলাদেশের বন্ধু নয়। বাংলাদেশের ভালো হবে, এমনটা ভেবে পাকিস্তান প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে, এমনটা আর যেই বিশ্বাস করুক, আমি করবো না। পাকিস্তানের কিছুটা বিবেচনা থাকতে পারে ধর্মীয়।

তবে আসল বিবেচনা রাখাইনে তাদের কালো হাতের থাবার বিস্তার ঘটানো। চলমান সঙ্কটের সূত্রপাত করেছিল যেই আরসা, তারা যে আইএসআইয়ের বানানো, সেটা নিশ্চয়ই নতুন করে বলে দিতে হবে না। আর যাই হোক, বাংলাদেশের ভালো কিছু হয়, এমনকিছু পাকিস্তান কখনোই করবে না।

বাংলাদেশের অস্তিত্বটাই পাকিস্তানকে তাদের পরাজয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া তাদের নিত্য অন্তর্জ্বালার কারণ। পাকিস্তান প্রসঙ্গে আমি শেষ কথা মানি হুমায়ুন আজাদের একটি উক্তিকে, ‘পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। ‘তাই পাকিস্তান জাতিসংঘে মিয়ানমারের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে শুনে কেউ কেউ উল্লসিত হতে পারেন, আমি নই।

পাকিস্তানকে আপনি অন্তরে ধারণ করলে করুন, কিন্তু বন্ধু ভাববেন না। আমার কাছে ভারত বা পাকিস্তান নয়, সবার আগে বাংলাদেশ। আমি সবার সাথে সম্পর্কটা বিবেচনা করি, বাংলাদেশের স্বার্থের নিরিখে। আর পররাষ্ট্রনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই।

একাত্তরে রাশিয়া আমাদের পক্ষে ছিল, এখন যেমন তারা মিয়ানমারের পক্ষে। আবার একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের বিপক্ষে, এখন আবার তারা মিয়ানমারের বিপক্ষে। ভারত একাত্তর সালে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল বলেই সারাজীবন তারা আমাদের বন্ধু থাকবে এমন কোনো কথা নেই। পাকিস্তান ছাড়া আমার কোনো চিরস্থায়ী শত্রু নেই।

 

প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com