ডেস্ক নিউজ:

মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আধিপত্য নিরঙ্কুশ করার প্রচেষ্টার মধ্যেই দেশটির সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আভাস মিলেছে। রিয়াদ ও তেল আবিবের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও লেবাননভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-আখবার এবং সৌদি সংবাদমাধ্যম এলাফ আভাস দিয়েছে, সৌদি-ইসরায়েল যৌথভাবে ইরানবিরোধী তৎপরতা চালাতে পারে। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি সৌদি রূপরেখার গোপন নথি পাওয়ার দাবি করেছে আল-আখবার। আর এলাফকে দেওয়া এক বিরল সাক্ষাৎকারে ইরান প্রশ্নে সৌদি আরবের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইসরায়েলি সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল গাদি এইসেঙ্কট।

সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্কের প্রতীকী ছবি
গত সেপ্টেম্বরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়ে গুঞ্জন উঠেছিল তিনি গোপনে ইসরায়েল সফর করেছেন। পরে অবশ্য সৌদি কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছিল। তবে লেবাননভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল আখবার বলছে, ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সৌদি আরব একটি রূপরেখা তৈরি করেছে। সেই রূপরেখা সম্বলিত চিঠিটি যুবরাজ এবং ডি ফ্যাক্টো বাদশাহ মোহাম্মদ বিন সালমানের কাছে পাঠিয়েছিলেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবেইর।

লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকা সংবাদমাধ্যম আল-আখবার জানিয়েছে, সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা ওই গোপন রূপরেখা তাদের হাতে এসেছে। সেখানে ওই রূপরেখার বিস্তারিত দেওয়া আছে।

যুবরাজের কাছে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাঠানো চিঠিটি প্রকাশ করেছে আল আখবার। চিঠির শুরুতে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেকার ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তির’ ভিত্তিতে সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আপনার কাছে একটি প্রকল্প জমা দিচ্ছি। আপনাদের উত্তম নির্দেশনা থেকে নেওয়া নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’

ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘সৌদি আরবের শান্তি প্রক্রিয়ায় আস্থা তৈরির মতো বিপুল প্রভাব ও কূটনৈতিক ক্ষমতা দেশটির রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তিতে সৌদি আরব অঙ্গীকার করেছে, কেবল মার্কিন-সৌদি প্রচেষ্টাই (শান্তির জন্য) সফলতার চাবিকাঠি….সৌদি আরবের সমর্থন ছাড়া ফিলিস্তিন ইস্যুকে বৈধতা দেওয়ার প্রশ্নের কোনও সমাধান নেই।’
চিঠিতে লেখা হয়েছে ‘সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সৌহার্দ্য ঝুঁকি তৈরি করে…এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন ইস্যু আধ্যাত্মিক, ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় মর্যাদা পায়। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী ইরানবিরোধী প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র সৎ; এ কথাটুকু অনুভব না করা পর্যন্ত সৌদি আরব এ ঝুঁকি নিতে পারে না।’

আল-আখবার জানায়, যার ওপর ভিত্তি করে সৌদি আরবের শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করা হয়েছে তা যুবরাজের কাছে পাঠানো চিঠিতে ক্রমানুসারে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো হলো:

এক: সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে যেকোনও ধরনের বৈরিতার অবসানের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সমতা থাকা প্রয়োজন। সামরিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক সমৃদ্ধ দেশ বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে হয় সৌদি আরবকে এ ধরনের শক্তি অর্জন করতে হবে না হয় ইসরায়েলের শক্তি অপসারণ করতে হবে।
দুই: আরব শান্তি উদ্যোগের বিতর্কিত বিষয়গুলোর যুক্তিসঙ্গত ও সৃজনশীল সমাধান বের করতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, আরব রাষ্ট্র এবং ইসলামী দেশগুলোর সঙ্গে সৌদি আরব কূটনৈতিক সক্ষমতা ব্যবহার করবে এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখবে। পাশাপাশি জেরুজালেম ও শরণার্থী এ দুটি মূল ইস্যুতে সৃজনশীল সমাধান গ্রহণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। সেগুলো হলো:

১৯৩৭ এর পিল প্রজেক্ট এবং জেরুজালেম নিয়ে জাতিসংঘের ১৯৪৭ এর পার্টিশন প্ল্যান গ্রহণের মাধ্যমে জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক সার্বভৌমত্বের আওতায় নিয়ে আসা।

ফিলিস্তিনিরা যেখানে আছে তাদেরকে সেখানেই পুনর্বাসিত করতে চায় সৌদি আরব। আরব লীগের সুপারিশ বিলুপ্ত করা এবং কোনও আরব দেশে ফিলিস্তিনিদের নাগরিকত্ব না দেওয়ার মতো প্রস্তাবগুলোকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে সৌদি আরব ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারবে।

তিন: একটি চূড়ান্ত সমাধান নীতি নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে প্রস্তাব দিয়েছে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে অঞ্চলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের পরই এ প্রস্তাব দেওয়া হয়। এরপর সেই নীতি এবং চূড়ান্ত সমাধান শুরুর জন্য আলোচনাকে স্বীকৃতি দিতে অঞ্চলের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্প।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু
চার: ইসরায়েল, আরব বিশ্ব এবং ইসলামী বিশ্বের মধ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূচনায় অন্যদের সমর্থন আদায়ে সৌদি আরব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ শুরুর ধাপগুলোতে আরব বিশ্বের জনসমর্থন পাওয়া যাবে না। অবশ্য, সৌদি আরব বিশ্বাস করে উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষমতা, তাদের বাজারের আকার এবং আরবের মানুষদের সম্ভাবনার সঙ্গে ইসরায়েলি প্রযুক্তির সঙ্গতির মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সুপ্ত সম্ভাবনাগুলো প্রকাশ হতে পারে এবং সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও শান্তি অর্জন করতে পারে।
পাঁচ: ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতটি দীর্ঘতম আঞ্চলিক সংকট। কট্টরপন্থীরা তাদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করতে এর ব্যবহার করে থাকে। এ সংঘাতের কারণে অঞ্চলের নেতাদের মনযোগ এককেন্দ্রিক থাকে না, তারা তখন ইরানকে অঞ্চলের প্রধান হুমকি হিসেবে বিবেচনা করার অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন।

চিঠিতে আরও বলা হয়, সংকট সমাধানের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে ইরানবিরোধী পারস্পরিক সহযোগিতার দুয়ার খুলে যাবে। তাছাড়া, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের কয়েকটি লক্ষ্য একই। সেগুলো হলো:

-মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের আগ্রাসী নীতিমালাকে উপস্থাপন করে এমন কোনও কর্মকাণ্ড মোকাবিলা করা

-ইরানের ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে মার্কিন ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বৃদ্ধি করা

-বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদে ইরানের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরালো করা

-ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির পারমাণবিক চুক্তির কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ছয় শক্তিধর দেশের অবস্থানের ব্যাপারে লবিং করা

-বাজেয়াপ্ত সম্পত্তিতে ইরানের প্রবেশাধিকার সীমিত করা এবং সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে ইরানের অর্থনেতিক সংকটকে পুঁজি করা

-ইরান ও হিজবুল্লাহ সমর্থিত সংগঠিত অপরাধ ও মাদক পাচারের বিরুদ্ধে পারস্পরিক গোয়েন্দা সহযোগিতা প্রদান করা।

এদিকে আল জাজিরা এলাফ-কে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, রিয়াদ ও তেহরানের আঞ্চলিক বৈরিতায় সৌদিকে খুব কাছ থেকে সহযোগিতা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান। কাতারভিত্তিক ওই সংবাদমাধ্যম বলছে,সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক কোনও সম্পর্ক না থাকায় এই সাক্ষাৎকারটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে ইসরায়েলের সেনাসূত্র সাক্ষাৎকারটির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। সাক্ষাৎকারে এইসেঙ্কট ইরানের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে জঙ্গি গোষ্ঠীকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার রোধে এখনই ইরানকে থামাতে হবে বলে মত দিয়েছেন তিনি। ইরানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আভাস দিলেও এখনই ইরান সমর্থিত হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লেবাননে হামলা চালাবেন না সাক্ষাৎকারে জানান এইসেঙ্কট।

আল জাজিরাকে সাক্ষাৎকারটির ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন জেরুজালেম পোস্টের সামরিক প্রতিনিধি আন্না আহরোনহেইম। এইসেঙ্কট কোনও ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন না উল্লেখ করে আহরোনহেইম বলেছেন, ‘এটা তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। নিশ্চয় এইসেঙ্কটের জন্য বিরাট পদক্ষেপ।’