হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ:
টেকনাফ উপজেলা আইন শৃংখলা ও চোরাচালান প্রতিরোধ টাস্কফোর্স কমিটির সভা অনুষ্টিত হয়েছে। এতে ইউনিভার্সিটি ছাত্র খুন এবং শামলাপুরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে প্রানবন্ত আলোচনা হয়েছে।
১৬ নভেম্বর সকাল ১১টায় টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্টিত হয়। সভা দু’টির সভাপতিত্ব করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জাহিদ হোসেন সিদ্দিক।
এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জাফর আহমদ বলেন ‘বর্তমানে টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবা চোরাচালান এবং খুচরা বিক্রেতা ও সেবনকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে একাধিক চালান ধরাও পড়েছে। বিশেষ করে খুচরা বিক্রেতা এবং সেবনকারীদের সংখ্যা গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রাম পুলিশ, মেম্বার, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, মেয়র যৌথভাবে নিরপেক্ষভাবে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ তালিকা করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করতে হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ইস্যু ভয়াবহ এবং ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এটি এখন জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে’। তিনি আরও ‘অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিকভাবে নিবন্ধন চলছে। পর্যায়ক্রমে এর আগে বিভিন্ন সময়ে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে নিবন্ধনহীন ভাড়া বাসায় বনাঞ্চলে সৈকতে লোকালয়ে বসবাস করছেন তাদেরকেও নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কোন অবস্থাতেই লোকালয়ে আশ্রয় দেয়া যাবেনা’। তিনি এব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে জনপ্রতিনিধি এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ সদস্য আলহাজ্ব মোঃ শপিক মিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মাওঃ রফিক উদ্দিন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মিস তাহেরা আক্তার মিলি, হোয়াইক্যং মডেল ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওঃ নুর আহমদ আনোয়ারী, বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মাওঃ আজিজ উদ্দিন, সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর হোসেন, হ্নীলা ইউপির চেয়ারম্যান প্যানেল-১ আবুল হোসেন মেম্বার, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড বাহিনী শাহপরীরদ্বীপ স্টেশনের এমএ আক্তার, টেকনাফ মডেল থানার সেকেন্ড অফিসার আবুল খায়ের, উপজেলা কৃষি অফিসারের প্রতিনিধি উপ-সহকারী কৃষি অফিসার মোঃ শফিউল আলম কুতুবী, সদর বিওপির সুবেদার মিজানুর রহমান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক দেবাষীশ চাকমা, আনসার-ভিডিপি অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) হ্লাম্যাছা, কমিটির সদস্য আলহাজ্ব সোনা আলী, আলহাজ্ব জহির হোসেন এমএ, আবুল কালাম, বন বিভাগের ফরেস্টার সাজ্জাদ হোসেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাওঃ আমির হোসেন, পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম মিনারুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

মাছ শিকার বন্ধ :
সভায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে শাহপরীরদ্বীপ থেকে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় জেলে, জেলে পরিবার এবং ভোক্তা সাধারণের সমস্যার কথা তুলে ধরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ সদস্য আলহাজ্ব মোঃ শফিক মিয়া বলেন ‘বর্তমানে গরীব অসহায় জেলে পরিবারগুলোতে হাহাকার চলছে। এ অবস্থা চলছে থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। অপরাধ প্রবণতাও বাড়ার আশংকা রয়েছে’। তিনি জেলে পরিবার গুলোকে রেশনের আওতায় আনার দাবি জানান।

রোহিঙ্গারা ক্যান্সার :
কমিটির সদস্য আলহাজ্ব সোনা আলী বলেন ‘রোহিঙ্গারা ক্যান্সারের মতো। এদের রুখতে হবে। রোহিঙ্গারা খুরেরমুখ সেনা বাহিনীর পয়েন্টে নবাগতা সেজে রেশনপাতি নিয়ে চলে যায়। আবার কয়েকদিন পরে কৌশলে এসে রেশন নিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই অব্যাহত রয়েছে’।

শামলাপুরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প :
বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মাওঃ আজিজ উদ্দিন বলেন ‘কক্সবাজার জেলা প্রশাসক শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ৮নং অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্প হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। এ অস্থায়ী ক্যাম্পটি সেনা বাহিনীর তত্বাবধানে এনজিওদের সহযোগিতায় সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক পরিচালিত হয়ে আসছে। এখানে সরকারি খাস জমি না থাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে সেনা বাহিনীর তত্বাবধানে ঝুপড়ি করে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা। সরকারের একাধিক মন্ত্রী, সাবেক সরকার প্রধান, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, দেশী-বিদেশী প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ অস্থায়ী ক্যাম্প পরিদর্শন এবং রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। এখানে নতুন অনুপ্রবেশকারী ৮০ হাজার রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। আরও বিশ হাজার রোহিঙ্গা ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে রয়েছে। বর্তমানে সেনা বাহিনীর তত্বাবধানে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তাদের নিবন্ধনের কাজ চলছে। আমরা মানবতার কারণে সরকারী নির্দেশনা মতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। সেনা বাহিনীসহ আইন শৃংখলা বাহিনীকে সর্বাতœক সহযোগিতা করছি। তাছাড়া স্থানীয় পরিষদের মেম্বারগণ, গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মানকতার সেবায় সাধ্যমত সহযোগিতা করছেন। কিন্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে রোহিঙ্গাদের অবস্থান নিয়ে ভাড়া নেয়ার মিথ্যা অজুহাতে ১৩ নভেম্বর বিকালে সহোদর দুই ভাইসহ তিন জনকে র‌্যাব আটক করে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ৬ মাস করে সাজা দিয়েছেন। অপর ২ জনকে অর্থদন্ড দেয়া হয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আটক তিন জন হলেন নয়াপাড়া গ্রামের কাদের হোসেনের দুই পুত্র জুহুর আলম (৪৭), আব্দুল মাবুদ (৩৮), আজিজুর রহমানের পুত্র সাকিব (৪২)। এধরণের ঘটনা নিয়ে ব্যাপক ভাবে পরস্পর শত্রুতা ও হয়রানি করার প্রবনতা এবং আশংকা দেখা দিয়েছে। সরকার বলছেন রোহিঙ্গাদের কারণে বিনা দোষে স্থানীয়দের হয়রানী না করতে। কিন্ত মিথ্যা অজুহাতে তদন্ত না করে এভাবে বাজার থেকে ধরে নিয়ে সাজা দিয়ে দিয়ে চালান দেয়া খুবই দুঃখজনক ঘটনা। নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বিনা ভাড়ায় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আর মানবতা দেখাতে গিয়ে জমির মালিকরা হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। স্থান সংকুলান হলে বাহারছড়ার সব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে গেলে আমরা সব দিক দিয়ে খুশী। কিন্ত বিনা অপরাধে এভাবে হয়রানীর শিকার হতে চাইনা’। এনিয়ে ব্যাপক আলোচনা শেষে রোহিঙ্গাদের স্ব-স্থানে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।

ভার্সিটি ছাত্র খুন :
টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ শাহজাহান মিয়া বলেন ‘টেকনাফের মহেশখালিয়া পাড়া ঘাটে পুলিশের ইয়াবা আটকের ঘটনার জের ধরে প্রকৃত অপরাধীদের কঠোর হস্তে দমন না করায় থামানো যাচ্ছেনা টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালীয়াপাড়া-হাজামপাড়ার সহিংস ঘটনা, সংঘাত ও দ্বন্ধ। বরং দিন দিন বাড়ছে। ইতিমধ্যেই বশর ও হামিদ গ্রুপের দ্বন্ধের কারনে পা কাটা ২জন, গুলিবিদ্ধ ২ জনসহ আহত হয়েছেন অনেকে। মহেশখালিয়া পাড়ায় আগামীতে আরও মারাতœক খুন-খারাবির আশংকা দেখা দিয়েছে। মহেশখালিয়া পাড়া এলাকা দীর্ঘ দিন ধরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রতি রাতেই গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আগামীতে আরো রক্তাক্ত ঘটনার আশংকা রয়েছে।
১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার সময় দুর্বৃত্তের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খুন হয়েছে। নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যুবক টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালিয়া পাড়া এলাকার আবদুস সালাম ফকিরের পুত্র দেলাওয়ার হোসাইন প্রকাশ ডালু (২০)। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাজমপাড়া বাজারে দেলাওয়ার হোসাইন প্রকাশ ডালুর উপর একদল সন্ত্রাসী আকস্মিক হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা দারালো ছুরি দিয়ে তাকে ব্যপকভাবে আঘত করে পালিয়ে যায়। আহত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ডালুকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে টেকনাফ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। সন্ত্রাসী হামলায় নিহত দেলাওয়ার হোসাইন প্রকাশ ডালু (২০) কক্সবাজারের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এলএলবিতে অধ্যয়নরত। কিছুদিন আগে এলাকার বর্তমান ইউপি মেম্বার হামিদের সাথে তার ভগ্নিপতি আবুল বশরের দ্বন্ধের সৃষ্টি হয়। এতে উভয় পক্ষে তিন জন মারাত্মক জখম প্রাপ্ত হয়ে ২ জন পঙ্গুত্ব বরন করেন। ২৫ আগষ্ট রাত ১০টায় টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুল হামিদের উপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। টেকনাফ পানবাজার এলাকা আল মদীনা নামক একটি পার্টস এর দোকানে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আবদুল হামিদ মেম্বারের বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় হাজম পাড়া এলাকায় টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশ খালিয়া পাড়ার নুরুল ইসলাম মেম্বার গুলিবিদ্ধ ও আবুল বশরের পা কর্তনের ঘটনা ঘটে। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আবদুল হামিদ মেম্বার ও বশর গ্রুপের মাাঝে এ ঘটনা বলে জানা গেছে। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে হাজমপাড়া বাজারের রাইহান ফার্মেসীতে অসুস্থ আবুল বশর ঔষধ নেওয়ার সময় সাদা নোহা থেকে একদল লোক আকস্মিক এসে আবুল বশরকে দা, কিরিছ দিয়ে হামলা করে পালিয়ে যায়। এতে আবুল বশরের বাম পা কর্তন ও শরীরের বিভিন্ন অংশে মারাতœক আহত অবস্থায় উদ্ধার করে টেকনাফ সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সাবেক মেম্বার নুরুল ইসলামের বাসায় গিয়ে দরজা থেকে গুলি করে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। গুলির আঘাতে ডান পা ক্ষত বিক্ষত নুরুল ইসলাম মেম্বারকে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। এভাবে একটার পর একটা অঘটন ঘটছে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালীয়াপাড়া ও হাজামপাড়া এলাকায়। সন্ত্রাসীরা কখন কার উপর চড়াও হয় এ আশংকায় ভুগছেন এলাকার মানুষ’। এনিয়ে আলোচনা শেষে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে পুলিশী টহল জোরদারসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে যৌথ সভা :
সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর হোসেন বলেন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে টেকনাফ সদর, বাহারছড়া ও সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যানগণের যৌথ উদ্যোগে সৈকতের সুবিধা মত স্থানে জেলে, ট্রলার মালিক ও মাঝিদের নিয়ে বিশেষ সচেতনতামুলক সভা করা হবে। এতে এলাকাবাসী ছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড এবং মিডিয়াকর্মীরা উপস্থিত থাকবেন। তাছাড়া দীর্ঘ বছর পরে হলেও শাহপরীরদ্বীপে পুলিশের একটি ইউনিট চালু হচ্ছে’।
এছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জাফর আহমদের সভাপতিত্বে মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভা এবং বিজয় দিবস অনুষ্টানের প্রস্ততি সভা অনুষ্টিত হয়েছে। এতে দপ্তরওয়ারী বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা এবং বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।