বাংলা ট্রিবিউন:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে চলছে দেদার চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও দুর্নীতি। জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করে চলছে জালিয়াতি। বাদ যায়নি রাষ্ট্রপতির নাম ভাঙানোও। তবে এসব বিষয় জানার পরেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তাদের পদক্ষেপ দায়সারা গোছের। শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ও কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতর এবং সংস্থার বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মকর্তার প্রশ্রয় ও সহযোগিতায় বিভিন্ন চক্র মন্ত্রণালয়, দফতর, সংস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা আদায় ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আদায় করে আসছে।

জেলা প্রশাসকের নম্বর ক্লোন করে টাকা দাবি করা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ও রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যের নাম ভাঙিয়েও তদবির করছে একশ্রেণির দালাল। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা দফতরগুলো প্রতিরোধ বা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দায়সারাভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আদেশ জারি বা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাদের কার্যক্রম।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নামে চাঁদাবাজি:
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে চাঁদা আদায়ের জন্য পদ্মা সেতুর প্রকল্পের নামে চাঁদা আদায় করার চেষ্টা চালায় একটি প্রতারক চক্র। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এ বিষয়ে সচেতন করা হয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের নামে জাল চিঠি তৈরি করে ওই চক্র। এই জালিয়াতি ঠেকাতে গত ২৮ সেপ্টেম্বর জরুরি আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। সিনিয়র সহকারী সচিব মো. শামসুল আলম স্বাক্ষরিত আদেশে জালিয়াত চক্রকে আইনের আওতায় আনারও নির্দেশ দেওয়া হয়।

পদ্মা সেতুর উন্নয়নের নামে যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতে না পারে সেজন্য সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, দেশের সব জেলা শিক্ষা অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছাড়া এ বিষয়ে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বাংলা ট্রিবিউনকে জানাতে পারেননি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালক ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান। তবে আদেশে স্বাক্ষরকারী সহকারী সচিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ও পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেছি।’

একইভাবে ২৫ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে সতর্ক করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতেও বলা হয়েছিল— স্বাক্ষর জাল করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পত্র জারি করেছে জালিয়াত চক্র। ওই পত্রে বলা হয়— পদ্মা সেতুর উন্নয়নে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পাঁচ টাকা হারে চাঁদা আদায় করে আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা বরাবর ডাচ বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বরে (শাহ আলম, ৭০১৭০১৫০৫৩০)পাঠাতে হবে।

অবকাঠামো নির্মাণের সহায়তার নামে প্রতারণা:
দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। বর্তমানে নির্ধারিত কিছু উপজেলায় এই নির্মাণ কাজ হবে। অন্য যেসব উপজেলায় অবকাঠামো উন্নয়নের সিদ্ধান্ত হয়নি, সেগুলোতে উন্নয়ন সহায়তা পাইয়ে দিতে বিভিন্ন টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ ওঠে।

সিরাজগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের আশ্বাস দিয়ে একশ্রেণির প্রতারক অর্থ আদায় করেছে, এমন অভিযোগ পায় কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর। বিষয়টি নিয়ে গত ১৮ অক্টোবর যুগ্ম সচিব মো. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।

সতর্কীকরণ এই বিজ্ঞপ্তির পর পরবর্তী কোনও পদক্ষেপ বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে যুগ্ম সচিব মো. মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন প্রকল্প পরিচালক। তবে আমরা সতর্ক করেছি।’

সরকারি সংস্থার নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি:
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রাইমারি এডুকেশন অর্গানাইজেশন লিমিটেড (পিইওএল) নামের একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে। এজন্য প্রতারক চক্র পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চাকরির প্রলোভন দেখায়। এরপর বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা নেয়। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ইস্যু করা পত্র, ভিজিটিং কার্ডসহ সবকিছুতেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সাদৃশ্যপূর্ণ নাম ও প্রকৃত ঠিকানা ব্যবহার করা হয়।

এ ঘটনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গত ২৯ অক্টোবর মিরপুর মডেল থানায় জিডি (নম্বর ২০৩৯) করা হয়। সচেতনতা বাড়াতে পরদিন ৩০ অক্টোবর উপ-সচিব এ.এইচ.এম গোলাম কিবরিয়া স্বাক্ষরিত আদেশ জারি করা হয়। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের অবহিত করা হলেও অপরাধীদের খুঁজে বের করার তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।

জেলা প্রশাসনের মোবাইল ক্লোন:
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের (ডিসি) অফিসিয়াল মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন করে গত ১ নভেম্বর প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়। ওইদিন জেলা প্রশাসনের নামে টাকা আদায়ের চেষ্টা করে একটি চক্র। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশ সুপারকে চিঠি দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে আইনের আওতায় নেওয়া যায়নি।

ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে অর্থ আদায়:
প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর স্ক্যান করে ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরি করছে একশ্রেণির কর্মকর্তা। এভাবে একটি চক্র বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আদায় করেছে। এ অভিযোগ আসার পর গত ৫ নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পক্ষ থেকে মিরপুর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। এর দুই দিন পর (৭ নভেম্বর) সচেতনতা বৃদ্ধিতে অধিদফতরের উপ-পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) মো. মাহবুবুর রহমান বিল্লাহ স্বাক্ষরিত আদেশ জারি করা হয়। তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও কোনও অগ্রগতি দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।

কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল:
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে বিভিন্ন অপকর্মের চেষ্টা করেছে প্রতারকরা। স্বাক্ষর জালের মাধ্যমে আদেশ তৈরি করে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণের সুবিধাও নেওয়ার চেষ্টা চালায় প্রতারক চক্র। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সতর্ক করা হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পুলক রঞ্জন সাহা স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়— প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের নামে জেলা যাচাই-বাছাই কমিটির সভায় উপস্থাপনের জন্য কিছু অসাধু লোক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল অথবা স্ক্যান করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে পাঠিয়েছেন। কিছু জেলা থেকে এমন ভুয়া পত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে।

তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা কমিটির অভিযোগ না থাকায় কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি বলে যুগ্ম সচিব পুলক রঞ্জন সাহা।

রাষ্ট্রপতির ও পরিবারের সদস্যদের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা আদায়:
রাষ্ট্রপতির নাম ভাঙানোর মতো কাজ করছে জালিয়াত ও দালাল চক্র। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নেন জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শামসুর রহমান। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতির সচিব। সরকারি তথ্য বিবরণীতে বিষয়টি ওঠে আসে গত ১৫ অক্টোবর।

শুধু তাই নয়, সরকারি তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়— কিছু অসাধু ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার অপচেষ্টা করছেন।

মন্ত্রণালয়ের নাম ভাঙাচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান:
সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও নাম ভাঙানোর প্রবণতা লক্ষণীয়। নাম ভাঙানো বন্ধে দুই দফা আদেশ জারি করে কৃষি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে গত ২৬ অক্টোবর উপ-সচিব দাউদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত আদেশে দফতর ও সংস্থার কর্মকর্তাদের গাড়ির উইন্ডশিল্ড থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নামফলক অপরাসরণ করতে বলা হয়।

একইসঙ্গে এখন থেকে কোনও সংস্থার গাড়িতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নামফলক ব্যবহারের দিকটি দেখা গেলে গাড়ি ব্যবহারকারী, দফতর ও সংস্থার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয় ওই আদেশে।