আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ইস্যুতে সরকারি দলের অবস্থানের পথেই হাঁটছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিএনপিসহ অন্তত ১০টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিলেও তাতে সায় নেই ইসির। তবে, বিদ্যমান আইনের মধ্যে থেকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি ইসির বিবেচনায় রয়েছে। ইসির আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার কমিটির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।

এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা সেনা মোতায়েনে বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে না যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। গত ২৮ ডিসেম্বর সংলাপ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব এলেও এটি নিয়ে এখন ভাবছি না। নির্বাচনের সময় বিষয়টি চিন্তা করব। বিদ্যমান আইনি কাঠামোর মধ্যেই সেনা মোতায়েন করা সম্ভব।’

নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তার প্রস্তাবে সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। তবে দেশের কোন পরিস্থিতিতে সেনা মোতায়েন করা যাবে, সে বিষয়ে দণ্ডবিধি ও সেনা বিধিমালায় স্পষ্ট করা হয়েছে বলে দলটি সংলাপের প্রস্তাবনায় বলেছে।

ফৌজদারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনও পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করা যাবে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯-১৩১ ও সেনা বিধিমালার In aid to civil power শিরোনামে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ ও ১৩০ ধারা অনুসারে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য কোনও ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন এলাকার পুলিশ কমিশনার সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে পারেন।

অবশ্য সংলাপে সেনা বাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি খোলাসা না করলেও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে এ বাহিনী নিয়োগের কথা বলেছে আওয়ামী লীগ।

ইসির সংলাপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপিসহ ১১টি ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে। এছাড়া বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ আরও ১৪টি দল যেকোনও ফরমেটে নির্বাচনে সেনা রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগসহ ৮টি দল সেনা মোতায়েন না করার প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে কেউ কেউ একান্ত প্রয়োজন হলে স্ট্রাইকিং ফোর্স বা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েনের কথা বলেছেন। ৫টি দল সেনা মোতায়েনের বিষয়টি ইলেকশন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, সুশীলসমাজের অনেকেই আরপিওতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছেন।

তবে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্তি—এ দু’টির কোনোটিরই পক্ষে ইসি নয়। ইসির অবস্থান স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে এই বাহিনীকে নিয়োগ দেওয়া। এ বিষয়ে ইসির যুগ্ম সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে নির্বাচনি মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েন হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এর বাইরে ভিন্ন কোনও পরিকল্পনা বর্তমান কমিশনের নেই।’

দেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েনের কোনও সুযোগ নেই বলে জনিয়েছেন ইসির আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার কমিটির প্রধান ও নির্বাচন কমিশনার বেগম কবিতা খানম। তিনি বলেন, ‘দেশের নির্বাচনি ইতিহাসে সেনাবাহিনীর হাতে কখনোই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এটা বাস্তবসম্মত নয়। যার হাতে বন্দুক, তার হাতে বিচারের ভার দেওয়া যায় না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কার কী ক্ষমতা, দেশের আইন ও সংবিধানে তা স্পষ্ট করে দেওয়া রয়েছে। একজনের ক্ষমতা অন্যজনের ভোগ করার কোনও সুযোগ নেই। আইনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া পারমিট করে না। সংলাপে যে দাবি এসেছে, তা হচ্ছে মেঠোকথা। যারা এই দাবি করেছেন, তারাও জানেন, আইন এটি পারমিট করে না। যা আইনে পারমিট করে না, কমিশন তা বাস্তবায়ন করবে কোন ক্ষতা বলে?’ তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী হচ্ছে দেশরক্ষা বাহিনী। অন্য যে বাহিনী রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এটা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। দেশের সংকটকালে বিশেষ প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন করা যেতে পারে। তাদের সহযোগিতার জন্য সেই সময় নিয়োগ করা যেতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে আছে ওই বিশেষ মুহূর্তে সহযোগিতার জন্য তাদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করে যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে আইনের মধ্যে থেকে সেভাবে সেনা মোতায়েনের প্রসঙ্গটি আসতে পারে।’

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মোতায়েনের জন্য কেউ দাবি করলেই তো সেটা দেওয়া সম্ভব নয়। দেখতে হবে এটা আইনের পারমিট করে কিনা। দেশের আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ফৌজদারি আইন ও আরপিও পারমিট করে না কোনও বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার। ইউনিফর্ম পরিহিত বাহিনীকে এ ক্ষমতা দেওয়া যায় না।’

সাবেক এই কমিশনার আরও জানান, সংলাপে অংশ নিয়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘আরপিওতে এটা যুক্ত করা হলে সেনাবাহিনী সেই অনুযায়ী কাজ করবে। এতে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারের সুযোগ পাবে। এভাবে রাখা হলে বেশি কার্যকর হবে। অতীতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় না থাকলে সেনাবাহিনীকে যে উদ্দেশ্যে মোতায়েন হয়, তা সফল হয় না। তবে এই কমিশন যদি বিদ্যমান ব্যবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে সেনা মোতায়েন করে বা কোনও সেনাবাহিনী ছাড়াই সফলভাবে নির্বাচন করতে পারে, তাহলে আমর সাধুবাদ জানাব।’

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী ও রক্ষীবাহিনী নিয়োগ করা হয়। এছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে পুলিশ ও আনসার বাহিনী নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ, আনসার ও বিডিআরের পাশাপাশি সেনাবাহিনী এবং কিছু এলাকায় নৌবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯/১৩০ ধারায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ‘ইনস্ট্রাকশন রিগার্ডিং এইড টু সিভিল পাওয়ার’ অনুযায়ী একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন এলাকার পুলিশ কমিশনারের জন্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনা ও নৌবাহিনী ব্যবহার করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। এ বাহিনীকে নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত শুধু ‘শো অব ফোর্স’-এর জন্য ব্যবহার করার সুযোগ ছিল। নির্বাচনের দিন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালনের সুযোগ হিসেবে প্রতিটি দলের সঙ্গে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছিল। একই পদ্ধতিতে ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা ও নৌবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরপিও সংশোধন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে অন্যান্য বাহিনীর মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১/১১-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনি আইন সংস্কারে র‌্যাবকেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে বিদায়ী রকিব উদ্দিন কমিশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে বাদ দেয়। এর ফলে সেনাবাহিনী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে স্ট্রাইকিং বা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ।

এদিকে সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সরকারি দলের অবস্থানের দিকে দৃষ্টি রয়েছে কমিশনের। সময় ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির কথা বিবেচনা করে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রতি ইসির আগ্রহ কম হলেও তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ধারাবাহিকভাবে এর ব্যবহার বাড়ানোর চিন্তা করছে। পাশাপাশি আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম হোক বা না হোক আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ সংশোধন করে তাতে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিধান যুক্ত করতে চায় ইসি।

এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চূড়ান্ত বিচারে আমাদের প্রযুক্তির দিকেই এগিয়ে যেতে হবে। ইভিএম আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দেব। এরপর সবাই যখন এটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন তখনই জাতীয় নির্বাচনেও এর ব্যবহার হবে।’ আরপিওকে ইভিএম-এর বিষয়টি যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছেও বলে জানান ইসি সচিব।