ডেস্ক নিউজ:
আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের আজকের এই দিনে প্রলয়ঙ্কারী বন্যার নারকীয় তাণ্ডবে নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চল সুবর্ণচর (তৎকালীন চরবাটা), কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া ও সদর পরিণত হয়েছিল বিরানভূমিতে।
১৯৭০ সালের বন্যায় নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি ছিল অবর্ণনীয়। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেদিন মধ্যরাতে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ‘গোর্কি’ বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ে এসব এলাকায় এক লাখের বেশি মানুষের সলিল সমাধি হয়। মারা যায় গবাদিপশুসহ অসংখ্য জীবজন্তু। সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে স্বজনহারাদের হাহাকার আর্তনাদ, আহাজারিতে এখনও কেঁপে ওঠে এখানকার আকাশ-বাতাস। অনেক পরিবারের বংশ শুন্য হয়ে যায়, আবার কারও পরিবারের দু-একজন বেঁচে থাকেন গাছের ডাল-পালা ও গবাদি পশুর লেজ ধরে।
১২ নভেম্বর ভোর বেলায় দেখা যায় চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। এ জনপদ যেন এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়। সারি-সারি শিশু, নারী, আবাল-বৃদ্ধের লাশের মিছিল। কাফন ছাড়াই দাফন হয়েছিল বেশির ভাগ লাশ। অনেকের লাশ জোয়ারে ভেসে যায় দূর-দূরান্তে। কোথাও কোথাও মানুষ, গবাদি-পশুর লাশ একই গর্তে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। লাশের পচা গন্ধে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের পরিবেশ। এই জনপদজুড়ে ছিল হৃদয় বিদারক হাহাকার আর বেঁচে থাকাদের আর্তনাদ। বিরান হয়ে গেছে মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম। জীবিত থাকা অনেকে ভেসে চলে গেছেন বিভিন্ন দ্বীপে। অনেকে স্মৃতি হারিয়ে হয়ত বেঁচে আছেন অন্য পরিচয়ে অন্য কোনও গ্রামে।

ভয়াল সেই গোর্কির আঘাত থেকে থেকে বেঁচে যাওয়া সুবর্ণচর উপজেলার পূর্বচরবাটা ইউনিয়নের তনজেবের নেসার (৮০) কাছে সেদিনের কথা জানতে চাইলে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, সেই বন্যায় আমার পরিবারের ১২ জন ভেসে গেছে। তাদের একজনেরও লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার ভাইয়ের পরিবারের ১৪ জনের সবাইকে হারিয়েছি। পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে হারিয়ে এখনও চাপ শোক বুকে নিয়ে বেঁচে আছি ।’

চর আমানউল্যাহ ইউনিয়নের জেলে পল্লির লালু মহাজন বাড়ির লালু চন্দ্র জল দাস (৮২), চারু বালা জল দাস (৭৭), কৃষ্ণপতি জলদাস (৭৯) জানান, বন্যার আগের দিন আকাশ খুব মেঘলা ছিল এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত ৮টার দিকে কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ বাতাসের তীব্রতা বেড়ে যায়। রেডিও না থাকায় আগাম কোনও পূর্বাভাসও পাইনি। রাত আনুমানিক ১১টার পর শোঁ শোঁ শব্দ করে জোয়ারের পানি সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কেবল বাঁচাও বাঁচাও বলে ভেসে যাওয়া মানুষের চিৎকার শোনা যায়। আমাদের ঘরে যখন বন্যার পানি ঢুকে তখন প্লাস্টিকের কন্টেইনার, ঘরে থাকা শুকনো কাঠের তক্তা ধরে আমরা ভেসে যাই অন্য গ্রামে। সকাল বেলা সূর্যের আলো পিঠে পড়ার পর আমরা জ্ঞান ফিরে পাই। বাড়িতে এসে দেখি কেউ নেই।

তারা জানান, তাদের বাড়ির ৪০ জন ভেসে গেছে। কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক সঙ্গে সবাইকে হারিয়ে তখন আর বাঁচতে ইচ্ছা করছিল না। তবুও স্বজন হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে আজও বেঁচে আছি কালের সাক্ষী হয়ে।

বাংলাদেশের ১৬টি ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় জেলার মধ্যে নোয়াখালী অন্যতম। নোয়াখালীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, সদর ও কবিরহাট উপজেলা। এছাড়াও ১৯৯১ সালের বন্যায় নোয়াখালী ও চট্রগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় এক লাখের বেশি মানুষ ও গবাদিপশু মারা গেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বার বার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে এ বিশাল জনপদ।

বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির নোয়াখালী জেলা সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনাম চৌধুরী জানান, জলবায়ুর প্রভাব যেভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যে কোনও সময় বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আবারও আঘাত হানতে পারে। আর তেমন কিছু ঘটলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে এ উপকূলে। তিনি বলেন,‘জেলার পাঁচটি উপকূলীয় উপজেলায় ১২ লাখের বেশি মানুষের জন্য আশ্রয়ণ কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ১৭০টি, যেখানে বড়জোর দুই লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। গবাদি পশুর আশ্রয়ের জন্য কিল্লা আছে হাতে গোনা কয়েকটি। সেগুলো আবার প্রভাবশালীদের দখলে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ নোয়াখালী জেলার হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, সুবর্ণচর ও সদর উপজেলায় বন উজাড় করে গড়ে ওঠা মেঘনার পাড়ে এবং বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অরক্ষিত জনপদে এখন প্রায় ১২ লাখের বেশি মানুষ বাস করছে। যারা সরাসরি প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয়ণ কেন্দ্র না থাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে এসব উপজেলার চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।

তিনি অভিযোগ করে বলেন,‘এত বিশাল জনগোষ্ঠীর দুর্যোগ মোকাবিলা ও আগাম বিপদ সংকেত দেওয়ার জন্য আবহাওয়া অফিস স্থাপনের দাবি দীর্ঘ দিনের হলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এই উপকূলীয় জনপদের প্রাণের দাবি-শিগগির একটি আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস স্থাপন করতে হবে।’