সৈয়দ মোহাম্মদ শাকিল
সারা দেশে আজ বুধবার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে এ ভূকম্পন অনুভূত হয়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় এ ভূমিকম্পর উৎপত্তিস্থল। গভীরতা ৩৩ কিলোমিটার। রিখটার স্কেলে ভূকম্পনের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৭। বাংলাদেশের সময় ১০টা ৫০ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের দিকে ভূকম্পন অনুভূত হয়। এটি ছিল মৃদু ভূকম্পন। প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১৪ কোটি মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে আঘাত হানার অপেক্ষায় অতি মাত্রার ভূমিকম্প। মৃদু, হালকা, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো তীব্র ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করছে। এমন অভিমত ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের।
ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিশেষ জোন কক্সবাজার।বিল্ডিং কোড ও কোন নিয়মনীতি না মেনে অপরিকল্পিত ভাবে কক্সবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। ফলে চরম ভুমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পর্যটন নগরী। একের পর এক তাড়াহুড়ো করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে তাতে ভূমিকম্পের আশঙ্কা বেড়েই যাচ্ছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন, নির্বিচারে পাহাড় কাটা, বিল্ডিং কোড না মেনে বহুতল ভবন নির্মাণ ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের ফলে দিন দিন ভূমিকম্প ঝুঁকি প্রবল হয়ে পড়ছে কক্সবাজার।
পর্যটন নগরীতে প্রতিবছর নতুন নতুন ভবন নির্মিত হচ্ছে । এসব ভবন নির্মাণে তদারকি সংস্থার ব্যর্থতা, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ও সিডিএ অনুমোদিত নকশা লঙ্ঘন এবং জনসচেতনতার অভাবে একে একে অপরিকল্পিত, ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মিত হচ্ছে। ফলে এসব অপরিকল্পিত, ত্রুটিপূর্ণ এসব ভবনের ৬৩ শতাংশই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। মাঝারি বা শক্তিশালী ভূমিকম্পে ধসে পড়তে পারে এসব ভবন। কক্সবাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই পৌরসভা ও গণপূর্ত বিভাগের। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কোনো সুনিদ্রিষ্ট তালিকাও নেই এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হলে উক্ত কর্মকর্তাদের সাফ জবাব ‘জানা নেই।
সরেজমিন দেখা গেছে, জেলা শহরে বহু বছরের পুরনো ও নিম্ন মানের ইট সুরকি দিয়ে তৈরি অনেক ভবন রয়েছে। যার অধিকাংশেরই অবস্থান জেলা শহরে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ব্যবহারীত হচ্ছে সরকারী কাজে। ভবনগুলো সাধারণ মানুষের চোঁখে অনেক আগেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অপরদিকে, নতুন ভবন নির্মাণেও নেওয়া হচ্ছে দুর্নীতির আশ্রয় মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে এসব ভবন। ফলে, ক্রমোশঃ পর্যটন নগরী কক্সবাজার আরও ঝুঁকিপূর্ণ নগরী হয়ে উঠছে। কক্সবাজার শহরের ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত স্থাপনাগুলোর অন্যতম জেলা ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের ২টি ভবন, খাস মহাল কার্যালয়ে অবস্থিত পুরনো ভবন, জেলা কৃষি অফিস কার্যালয়, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার কার্যালয়, কাস্টম অফিস, জেলা শহরের সাইক্লোন সেল্টার গুলো, জেলার ব্রিটিশ আমলে তৈরি বরফ কল গুলো, উপজেলা পরিষদ প্রশাসনিক ভবন, টকি হাউস সিনেমা হল ভবন, শহরের বড় বাজার এ সালাম শপিং কমপ্লেক্স এর পিছনে অবস্থিত ৪তলা ভবন, পৌর সুপার মার্কেট, প্রধান সড়কস্থ সিকদার মহল, ফজল মার্কেট, রক্ষিত মার্কেট, হোটেল হলিডে, হোটেল আল মুবিন, হোটেল আল নিজাম, হোটেল বাহাদুর, হোটেল মেহমান, শেখ রাসেল সড়কে এয়াকুব মঞ্জিল, নুনিয়ার ছরায় ১৮টি, নতুন বাহার ছরায় ৬টি, বইল্যা পাড়ায় ১১টি, টেকপাড়ায় ১৩টি, কালুর দোকান এলাকায় ৭টি, রুমালিয়ার ছরায় ১১টি, বিডিআর ক্যাম্প এলাকায় ১৩টিসহ উপজেলার কুতুবদিয়ায় ৪৩টি ভবন, মহেশখালীতে ৬৫ ভবন, উখিয়ায় ২৭টি ভবন, টেকনাফে ৩৬ টি ভবন, পেকুয়ায় ৩৯টি ভবন, চকরিয়ায় ৪২টি ভবন, রামুতে ২১টি ভবন এগুলোর সিংহভাগই ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। জরাজীর্ণ এসব ভবন এখন যেন মৃত্যুকূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভূ-গাঠনিক অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।কক্সবাজারের-মিয়ানমার সীমান্তে ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আরও বড় মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ নগরায়ণে মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে জেলার অধিকাংশ ভবনই টিকবে না। অথচ বৃহত্তর চট্টগ্রামে রিখটার স্কেলে ৭ বা ততোধিক মাত্রার শক্তিশালী ভূকম্পনের শঙ্কা রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণে পর্যটন নগরী কক্সবাজার কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তা আঁতকে ওঠার মতো।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূ-স্তরে ৪টি বিপজ্জনক ফাটল লাইন প্রবল ভূকম্পনের দিক নির্দেশ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ এ ধরনের তিনটি প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। এ ছাড়া দেশের মধ্যে থাকা চ্যুতি বা ফল্ট লাইনগুলো যেকোনো সময় ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ ভূমিকম্প। কক্সবাজারের সাথে সীতাকুণ্ড-টেকনাফ চ্যুতিটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
ভূবিজ্ঞানীরা আরো বলেন, স্থলভাগের পরিসর ক্রমেই কমে আসছে সমুদ্র তলদেশের বিস্তারের মাধ্যমে। সমুদ্রের তলদেশ বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি বেড়ে গেছে ভূমিকম্প। সমুদ্র তলদেশে বিস্তারের বেশ কিছু কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্থলভাগ থেকে পাহাড়ের মাটি গিয়ে ভরাট হওয়া। এ ছাড়া যেসব এলাকার তলদেশে পাথরের পরিমাণ বেশি মূলত শক্ত; সেখানে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি কম অনুভূত হয়। আর যেখানের তলদেশ নরম তথা কাদামাটির, সেখানে ঝাঁকুনি অনুভূত হয় বেশি।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চুয়েটের আর্থকোয়াক রিসার্চ ইনস্টিউটের গবেষণা বলছে, ইউরেসিয়া ও ইন্দো-অস্ট্রেলিয়া প্লেটের উপর অবস্থিত বাংলাদেশের দক্ষিন-পূর্বাঞ্চল, যার বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে মাটির নীচে আছে তিনটি প্লেট বাউন্ডারি।
সম্প্রতি যে ভূমিকম্প হচ্ছে তাতে এইসব প্লেট বাউন্ডারিতে ঘর্ষণ বাড়তে পারে আশংকা গবেষকদের। আর এতেই বেড়েছে ভূকম্পের ঝুঁকি যা হতে পারে রিখটার স্কেলে আট থেকে সাড়ে আট মাত্রার।
কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজের জন্য উদ্ধার কাজের ভারি সব ধরণের যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে।তবে এই ধরণের যন্ত্রপাতি সেনাবাহিনীর রয়েছে এবং তারা ছাড়া আর কেউ এগুলো চালাতে পারে না। কক্সবাজারে আমরা ইতোমধ্যে ৩ হাজারের অধিক মানুষকে ভূমিকম্প সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আরো লোককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের মতে, কক্সবাজারের সমুদ্রবেষ্টিত পাহাড়গুলো দিন দিন কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে মাটি স্থির থাকার ভারসাম্য ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে। এতে ভূমিকম্পের ঝুঁকিটা তীব্রতার দিকে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল বলেন, ‘ঘন ঘন ভূমিকম্প তীব্র ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করে। তাই ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে দুর্যোগ এড়াতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
ভূ-তত্ত্ববিদের মতে, ১৯৭৯ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ সিসমিক জোনিং ম্যাপে চট্টগ্রামকে সবচেয়ে বিপদসংকুল অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানী ফিল কামিলও এক গবেষণায় চট্টগ্রামকে ভূমিকম্প ও সুনামির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া আন্তর্জাতিক ভূ-তত্ত্ববিজ্ঞানী মিস্টার বার্নের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার অধিক ৬টি ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তবে পৃথিবীর ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল তথা হিমালয় বেল্টে অবস্থান করার কারণে চট্টগ্রাম সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে যাওয়া ফল্টলাইন ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় গত দেড় শ বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। এসব এলাকায় যেকোনো সময় বড় ভূমিকম্প হতে পারে।
কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকার ৪১টি ইউনিয়ন কম-বেশি বূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ ছাড়া ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ভূ-গঠন অনুসারে এ অঞ্চলের অবস্থান পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পন বলয়ে। বিশ্বে সাধারণত ভূ-কম্পনপ্রবণ এলাকায় ৫০, ৭০, ১০০, ১৫০ বছর পরপর প্রবল বা শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে মৃদু, হালকা, মাঝারি মাত্রার ভূকম্পনের কারণে এ অঞ্চলের ফল্ট লাইনগুলো নাজুক হয়ে পড়ছে। যা অদূর ভবিষ্যতে আরও প্রবল মাত্রায় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করছে।
২০ বছর আগে যে ভবণগুলো নির্মিত হয়েছে সেগুলো মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।এছাড়া কক্সবাজার শহরে কোন নিয়মনীতি ছাড়া যেভাবে বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে হঠাৎ ভূমিকম্পে ধ্বংসজজ্ঞ এবং প্রাণহানি এড়ানো প্রায় অসম্ভব।তাই নজর দিতে হবে ক্ষতি কমানোর দিকেই। অদূর ভবিষ্যতে ৭ মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হলে পর্যটন নগরীর কক্সবাজারের বহুতল ভবনের ৭০ শতাংশই ধসে পড়তে পারে যা ঘটাবে মহাদূর্যোগ।