গোলাম আজম খান:

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারনে এখন নানা ধরণের সমস্যায় পড়েছেন কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজন। পর্যটন মৌসুমেও টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল এবং প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে গত দু’মাস ধরে সাগর ও নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। একই কারণে পর্যটন শিল্প নির্ভর দ্বীপ সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা ও টেকনাফ উপকূলের জেলেরা গত দু’মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা একবেলা খাবার পেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। চরম বেকায়দায় পড়েছেন পর্যটন শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় মাঝি-মাল্লাসহ মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে গত দু’মাস ধরে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। জাহাজ চলাচল শুরু করতে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক বসলেও সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা শেষ হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে নৌমন্ত্রী বৈঠক করে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে বৈঠকে জানানো হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত পেন্ডিং থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে নৌ-মন্ত্রণালয় কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় সুপারিশ করা হয়েছে, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড় দিলেই জাহাজ চলাচল শুরু হবে।’

সুত্র জানায়, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন নৌপথের দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী নাফ নদী হয়ে যেতে হয় প্রায় ২৪ নটিক্যাল মাইল। সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় ১০ নটিক্যাল মাইল। নাফ নদীর অংশ পার হওয়ার সময় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপি একাধিকবার বাংলাদেশি নৌযানে গুলি চালায়। এ পরিস্থিতিতে মাছ ধরার ট্রলারের পাশাপাশি যাত্রী ও পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়।

বৈঠকের পর ট্যুর অপারেটরস-কক্সবাজার এর যুগ্ম আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে দু’মাস ধরে। এতে করে এ মৌসুমে দেশি প্রায় ১০ লাখ পর্যটক বাইরের দেশে চলে যাবেন। ইতোমধ্যেই অনেক পর্যটক বাইরে চলে গেছেন। এছাড়া, জাহাজ চলাচল না করায় ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন অনিশ্চতার মধ্যে।’ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন ভিত্তিক পর্যটন শিল্পে।

উল্লেখ্য, প্রতি বছর অক্টোবরের শুরু থেকে পরের বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার।

স্থানীয় বিজিবি সুত্র জানায়, ইয়াবা চোরাচালান রোধে প্রশাসনের নির্দেশে অক্টোবর মাস এ অঞ্চলে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। এর আগে ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করলে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়।

শাহপরীর দ্বীপের জেলে মোহাম্মদ কবির বলেন, মাছ ধরতে যেতে পারলে ঘরের চুলায় আগুন জ্বলে, না পারলে খাওয়া জোটে না। প্রায় দু’মাস সাগরে যেতে পারছি না। চোখের সামনে স্ত্রী-সন্তানকে উপবাস করতে দেখার যন্ত্রণা আর সইতে পারি না।

কবির জানান, তার বাপ-দাদা জেলে ছিল। তাই তিনিও এ পেশায় এসেছেন। দু’বছর আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে তার বড় ভাইয়ের মৃত্যু হয়।

মাছ ব্যবসায়ী ও নৌকার মালিক আবদুস সালাম বলেন, শাহপরীর দ্বীপ ঘাটে তিন শতাধিক ট্রলার ও নৌকা আছে। এসব ট্রলার ও নৌকাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের সংসার চলত। কিন্তু দু’মাস ধরে সাগর ও নাফ নদে মাছ ধরতে না দেয়ায় তাদের সংসারে দুর্দিন যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, সব জেলেরা চোরাচালানে জড়িত নয়। যারা জড়িত, তাদের বাদ দিয়ে বাকিদের মাছ শিকারে যেতে দেয়ার দাবি জানান তিনি।

সেন্টমার্টিনের জেলে দলিলুর রহমান ও বাহারছড়ার নুর খালেক জানান, ভরা মৌসুমে সাগরে নামতে না পারায় সব জেলে পরিবারে দেখা দিয়েছে অভাব-অনটন। ঘরে চাল-ডালের মজুদ শেষ। দু’দিন ধরে ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার দিতে পারেননি তিনি।

শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রিপাড়ার জেলে পরিবারের গৃহবধূ জাহানারা বেগম বলেন, পরিবারের সাত সদস্যের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।

মাঝি নূর আমিন বলেন, দু’মাস ধরে ঘাটে বেঁধে রাখায় ট্রলারের নিচের তক্তা পচে গেছে। পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে ইঞ্জিন। এখন ২০ হাজার টাকা খরচ করে ইঞ্জিন মেরামত করতে হবে।

সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নূর হোসেন বলেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার ঢল নামায় তাৎক্ষণিকভাবে নাফ নদে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, অনেকে জেলের বেশে নৌকায় ইয়াবা পাচার করে থাকে। চোরাচালান প্রতিরোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সাগর ও নাফ নদে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।

পাঁচ জেলেকে সাগর থেকে উদ্ধার
এদিকে সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া পাঁচ বাংলাদেশী জেলেকে পানিতে ফেলে দিয়ে মাছসহ ট্রলার নিয়ে গেছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। পরে নাফনদী থেকে তাদেরকে উদ্ধার করেছেন বিজিবির সদস্যরা। শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে সেন্টমার্টিনের পূর্ব-দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে এ ঘটনা ঘটে।

উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন- রোভেল (২৫), মো. ইলিয়াছ (২২), নাজিম উদ্দিন (২৬), সৈয়দ উল্লাহ (৩০) ও আলমগীর (৩০)।

তাদের বাড়ি টেকনাফ সাবরাং বাহারছড়ার এলাকায়।

তারা জানান, শুক্রবার ভোরে বাংলাদেশের পানিসীমায় সাগরে মাছ ধরছিলেন তারা। এ সময় মিয়ানমার পুলিশ একটি স্পিড বোটে এসে অস্ত্র তাক করে তাদের ঘিরে ফেলে। পরে মারধর করে তাদের সাগরে ফেলে দিয়ে মাছসহ ট্রলার নিয়ে চলে যায় তারা।

জেলেরা আরো জানান, সাগর থেকে সাঁতরে নাফনদীর শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়ার কাছাকাছি পৌঁছলে বিজিবি সদস্যরা তাদের উদ্ধার করেন।

টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার সকালে নাফনদী থেকে পাঁচ জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নাফনদীতে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু তারা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ শিকারের নামে টাকার লোভে রোহিঙ্গাদের আনতে গিয়েছিল বলে তাদের ধারণা। তিনি আরো জানান, জেলেদের আটক করা হয়েছে এবং ট্রলার নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

নদী সাঁতরে এসেছেন ১৯ রোহিঙ্গা
আবারো বুকে জারিক্যান বেধে নাফ নদী সাঁতরে শাহপরীর দ্বীপে এসেছেন ১৯ রোহিঙ্গা যুবক। আরাকানে সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও হত্যার হাত থেকে বাচঁতে তেলের জারিকেনের সহযোগিতায় সাঁতরিয়ে নাফ নদী পাড়ি দেয়া ১৯ রোহিঙ্গা যুবককে উদ্ধার করেছে বিজিবি।

গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে শাহপরীর দ্বীপের জেটি সংলগ্ন নাফ নদী থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া ১৯ জনের সবাই বুচিডংয়ের চিনডিপ্রাং গ্রামের বাসিন্দা বলে জানা গেছে।

টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান, তাদের উদ্ধার করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও মানবিক সহায়তা দিয়ে ক্যাম্পে পাঠাতে সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হয়েছে।

নাফনদী সাঁতরিয়ে বাংলাদেশে আসা ১৯ রোহিঙ্গা হলেন- রাসিডং এলাকার আব্দুল মোনাফ (৩০), ছাবের আহমদ (১৪), বুসিডং এলাকার আনোয়ার খালেদ (১৯), জাহেদ উল্লাহ (২২), মোহাম্মদ ইয়াছিন (১৫), রহমত উল্লাহ (১৭), আজিজুর রহমান (১৮), মোঃ আয়াজ (১৬), আবু সৈয়দ (২৪), মোঃ নুর (১৮), কবির আহমদ (২১), সিরাজুল ইসলাম (৩২), নুর কবির (২৪), পুইম আলী এলাকার মোঃ আয়ুব (২৬), নজির আহমদ (২০), আব্দুল আজিজ (২২), জহির আহমদ (২২), মংডু কাইন্দা পাড়ার মোঃ নুর (১৯),মংডু শহরের ফরিদ আলম (১৭)।

আরাকানে সহিংসতা অব্যাহত
মিয়ানমারের আরাকানে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ফলে জীবন বাঁচাতে সীমান্তের কাটাতার ও নাফ নদী অতিক্রম করে প্রতিদিন বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এর সমন্বয়ক সৈকত বিশ্বাস জানান, গত দু’দিনে উখিয়ার পালংখালীর আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত দিয়ে তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। তাদেরকে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

নতুন আসা এই রোহিঙ্গারা জানান, অনুপ্রবেশের জন্য নাফ নদীর ওপারে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষায় রয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে গত গত ২৫ আগস্ট থেকে দেশ ছাড়তে শুরু করে রোহিঙ্গা জনগোষ্টী।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)’র তথ্য মতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন ছয় লাখ ১৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। তবে স্থানীয়দের দাবি এ সংখ্যা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে।