আলহাজ্ব মুহাম্মদ শওকত আলী নূর

ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের মানুষের কাছে দ্বিতীয় বিজয় দিবস। এ সংগ্রামের নায়ক ছিলেন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সৈনিকবৃন্দ এবং এদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় ও গণতন্ত্রপ্রেমিক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ লক্ষ কোটি জনতা। এই অভ্যুত্থানের মহানায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার ঘোষক তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। বর্তমানে বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিবেশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আবারো ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ব্যর্থতাগুলো ভিন্ন মাত্রায় আবির্ভুত হয়েছে। একদলীয় বাকশাল শাসনব্যবস্থা পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রের আড়ালে নিজস্ব বিরোধীদল সৃষ্টির মাধ্যমে সুকৌশলে আরোপ করা হয়েছে। কাজেই ৭ নভেম্বরের চেতনা এদেশের আপামর জনগণের বুঝা ও জানা আজ বড় বেশি দরকার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানে তৎকালীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ৩ নভেম্বর এক পাল্টা অভ্যুত্থানে ১৫ আগস্টের ঘটনার ক্ষমতা লাভকারী সেনা অফিসারদের ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে। সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পদচ্যুত ও বন্দী করা হয়। এরই মধ্যে রাজনৈতিক আকাশে নানা ধরনের গুঞ্জন ও টানাপোড়নের মধ্যে একটি ঘটনা ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে ভিন্ন মাত্রা প্রদান করে। অভ্যুত্থানের নেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশরফের মা ও ভাই রাশেদ মোশারফের নেতৃত্বে ৪ নভেম্বর ‘মুজিব দিবস’ পালন করা হয়। ফলে সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনা সমৃদ্ধ সাধারণ জনগণ এবং আন্তর্জাতিক মহল ধারণা করেন যে, ৩ নভেম্বরের এই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী অবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে নেয়া। ওয়ার্কাস পার্টির নেতা হায়দার আকবর খান রনো লিখেছেন, “সকলেই ধরে নিল খালেদ মোশারফ ভারতপন্থী আর জিয়া বাকশাল ও ভারত বিরোধী।” (মার্কসবাদ ও সমাজ সংগ্রাম: ১৯৮২ পৃ: ১১৭)

সাধারণ জনগণ এবং সৈনিকগনের মধ্যে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। নানা ঘটনার পর ৭ নভেম্বর প্রথম প্রহরেই সৈনিকরা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে। এই বিপ্লবকে স্বতঃস্ফুর্ত সাহস, প্রেরণা সহযোগিতা যুগিয়েছিল দেশের সাধারণ জনগণ। সৈনিক ও জনতা একত্রিত হয়েছিলেন বলেই ৭ নভেম্বর সকলের কাছে সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে অভিহিত হয়ে আছে।

ঢাকা সেনানিবাসের আটক অবস্থা থেকে ফুলের মালা গলায় বীর সেনানী তৎকালীন সৈনিক ও জনতার প্রিয় জেনারেল জিয়া দিশাহীন জাতি, বিপদগ্রস্ত জনতা আর ভাই হারা সৈনিকদের কাছে উপস্থিত হলেন অমানিশার অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হিসেবে।

৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘গণতন্ত্র’ কে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানব সত্ত্বার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে’। কিন্তু ৭২-৭৫ সালের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করলে দেখা যাবে যে, তৎকালীন সরকার সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছিল। সর্ববিষয়ে অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। যা এই পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

সংবিধান ও গণতন্ত্রের কি অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তা বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাষায়, “১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধনী সংবিধানে আমূল পরিবর্তন করে। এতে সংসদীয় ব্যবস্থা পরিহার করে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। একই সংশোধনী একটি জাতীয় দল স্থাপনেরও ব্যবস্থা করে। কিছু দিনের মধ্যেই সর্ব ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রপতি একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দূর্যোগের সূচনা হলো এই সময় থেকেই। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও সামরিক শাসনের উম্মেষ হয় এই সংশোধনীর সুযোগ নিয়ে। আইনগতভাবে যথেচ্ছ শাসনের বীজ বপন হয় এই পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে। চতুর্থ সংশোধনী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত আদর্শবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।” (বাংলাদেশ পূনর্গঠন ও জাতীয় ঐক্যমত, ১৯৯১, পৃ: ১০৯)

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবুল ফজল, তাঁর “বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতি” ১৯৮৮ পৃ: ১১৮ এ মন্তব্য করেছেন, “৪র্থ সংশোধনী দ্বারা বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে এক দলীয় রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। সংসদ, মন্ত্রীসভা, বিচার বিভাগ এবং দল সবই রাষ্ট্রপতির অধীনস্ত হওয়ায় রাষ্ট্রপতি ‘সংবিধানের মূল প্রস্তরে’ পরিণত হন। কার্যত একজন মার্কিন রাষ্ট্রপতি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সচিবের সকল ক্ষমতা একত্রিভুত হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির হাতে।”

কাজেই এই দুইটি উদ্বৃতি থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা নেই যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জণগনের মানবাধিকার, ৩০ লক্ষ শহীদের আশা আকাঙ্খার প্রতি তৎকালীন সরকার ও সরকারী দল কি পরিমান অশ্রদ্ধা ও নৈতিকতাহীন কাজ করেছিলেন। একদলীয় বাকশালে সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ দেয়া হয়।

৭ নভেম্বরের চেতনা ছিল সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চিন্তা প্রসূত। এদিন জনগণ তাদের হারানো অধিকার ও ক্ষমতা ফিরে পায়। তাই এই দিনটিকে ২য় বিজয় দিবস হিসেবে অভিহিত করা যায়।

সেই দিনের ঢাকা শহরের বর্ণনা দিতে গিয়ে এন্থনী ম্যাসকারেনহাস তাঁর বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড (অনুবাদ গ্রন্থ পৃ: ১২২) লিখেছেন, “উল্লসিত কিছু সৈনিক আর বেসামরিক লোক নিয়ে কতগুলো ট্যাঙ্ক ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় চলাচল করতে দেখা যায়। এবার ট্যাঙ্ক দেখে লোকজন ভয়ে না পালিয়ে ট্যাঙ্কের সৈনিকদের সাথে একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং উচ্ছাসে ফেটে পড়ে। চারদিন ধরে তারা মনে করেছিল যে, খালেদ মোশারফকে দিয়ে ভারত তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা খর্ব করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এতক্ষণে তাদের সেই দুঃস্বপ্ন কেটে গেল। জনতা সৈনিকদের তাদের ত্রাণকর্তা বলে অভিনন্দন করল। সর্বত্র জোয়ান আর সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সাথে কোলাকুলি শুরু করে। রাস্তায় নেমে সারা রাতভর তারা শ্লোগান দিতে থাকে আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ ইত্যাদি। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গণজাগরনের মত জনমত আবার জেগে উঠেছে। এটা ছিল সত্যিই এক স্মরণীয় রাত।”

৭ নভেম্বর আমরা কি পেলাম? বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে এই বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক। সেনাবাহিনীর উপ প্রধান হিসেবে বাকশালে যোগদিতে বাধ্য হলেও দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার লাভ করেই জেনারেল জিয়া পর্যায়ক্রমে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পথে অগ্রসর হলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া কর্তৃক সামরিক আইন প্রত্যাহার, জরুরী অবস্থার অবসান ঘোষণা, বাকশাল বিলুপ্ত করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনপ্রবর্তন, মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতাসহ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদান, উন্নয়নের রাজনীতি, দেশের জনগণের জানমাল ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা প্রদান, বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে তুলে ধরা এবং এদেশের জনগণের সঠিক পরিচয় “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” প্রতিষ্ঠা এদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

জেনারেল জিয়া শিক্ষিত বেকারদের গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত রাখার জন্য শিল্প কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা এবং কৃষকের উন্নয়নের জন্য খাল খনন ও নদী সংস্কার শুরু করেন। মেধাবী ছাত্রদেরকে বার্ষিক সমুদ্র ভ্রমনের সুযোগ করে দিয়ে অনুপ্রানিত ও উদ্বুদ্ধ করেন। দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য ঐতিহাসিক ১৯ দফা কর্মসূচি চালু করেন।

জিয়া কলকারখানা চালাতে উন্নয়নের স্বার্থে দুই শিফটে কাজ শুরু করান। শিল্পায়নে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। গণশিক্ষা অভিযান শুরু করে ৪২ লক্ষ লোককে স্বাক্ষরতা জ্ঞান দান করা হয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা শুরু করেন। জেনারেল জিয়ার উদার মানসিকতার কারণে একটি আধুনিক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নবজন্ম হয়।

জেনারেল জিয়া ১৯৭৭ সালের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযুক্ত করেন। সকল কর্মের ভিত্তি হিসেবে আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থাই অন্যতম মূলনীতি বলে গৃহীত হয়।

সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা জেনারেল জিয়া, এর রূপকারও তিনি। দক্ষিণ এশিয়ান সংস্কার মাধ্যমে এই অঞ্চলকে এক ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত করে তোলার চেষ্টা করেছেন। মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে তৈরি করলেন নতুন সেতু বন্ধন। প্রযুক্তি নির্ভর দেশগুলো থেকে তিনি প্রযুক্তি আমদানি করলেন। কৃষি প্রধান বাংলাদেশকে তিনি সবুজ বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সম্মানের সঙ্গে বসবাসকে অগ্রাধিকার দিলেন। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চাইলেন অনেক অনেক উঁচুতে। অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিলেন। এই সময় সৌদিআরব হয়ে উঠে বাংলাদেশের পরম বন্ধু। বাংলাদেশ আলকুদ্দস কমিটির সদস্যপদ লাভ করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচিত হয়ে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যার সুফল এখন বাংলাদেশ লাভ করে যাচ্ছে।

আজ অনেকে অনেক কিছুই বলেন। কিন্তু ইতিহাস তো ইতিহাসই। জিয়া কি সামরিক শাসন জারি করেছিলেন? না। তাই তিনি সামরিক শাসক নন। তিনি রাজনীতিতে বিশেষ প্রেক্ষাপটে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এদেশের শতমুখী নৈরাজ্যের মধ্যে তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। আওয়ামীলীগ সহ সকল দলকে বৈধতা ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। সেনাবাহিনীকে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে তিনিই সফল হয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করে তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। জিয়া দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের এদেশে বিনিয়োগে উৎসাহ দিয়েছেন। বেসরকারী খাতকে তিনি উৎসাহিত করেছিলেন বলেই আজকের ব্যাংক, বীমা, গার্মেন্টস শিল্পসহ অনেক কিছুই বেসরকারী খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

গণতন্ত্র ধ্বংস করেছিলো ১৯৭৫ সালে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকার। সামরিক শাসন জারি করেছিলেন আরেক আওয়ামীলীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ। জিয়া সেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করে।

জিয়া ছিলেন গণমানুষের নেতা, অনুকরণীয় কর্মবীর। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া ৭ নভেম্বরের চেতনার হয়ে উঠেন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি আমাদের জাতিসত্তার রূপকার। স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রনায়ক। বীর মুক্তিযোদ্ধা, সফল রাষ্ট্রনায়ক, স্বাধীনতার মহান ঘোষক এক বীর সেনানী শহীদ জিয়া। ৭ নভেম্বরের চেতনায় জিয়া কর্তৃক যে ৫ম সংশোধনী সংবিধানে গৃহিত হয়েছিল বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মোহিতের মতে, এই সংশোধনীর সুফল ৩টিÑ (১) একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অবসান (২) মৌলিক অধিকার প্রয়োগে বিচার বিভাগের ক্ষমতা পুনর্বহাল এবং (৩) সংবিধানের পুনরুজ্জীবন। [ বাংলাদেশ পূনর্গঠন ও জাতীয় ঐক্যমত ১৯৯১, পৃ: ১১৫]

এখানে উল্লেখ যে, জিয়া প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ১৯৯১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার শুরুতেই সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রের সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে। ইতিহাসের কষ্টি পাথরে বিচার করলে বুঝা যায় যে, ৭ নভেম্বরের ফসল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলই এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমানে আওয়ামীলীগ সরকার পুনরায় মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে যাচ্ছে। আবারো নানা চলচাতুরীর মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সংবিধান সংশোধন এবং নীতিমালা ঘোষণা, প্রজ্ঞাপন জারী করে জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করছে। আওয়ামীলীগ একদলীয় বাকশালী চেতনা থেকে এক চুল পরিমাণও সরে আসেনি। আধুনিক উদার বিকশিত গণতন্ত্রের পথে মনে প্রাণে আসতে পারেনি। বহুদলীয় গণতন্ত্রের আবরনে একদলীয় শাসনের আধুনিক রূপকল্প তৈরি করে দেশের মানুষের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, নীপিড়ন, গুম, হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন পদ্ধতিতে। প্রতিটি সংসদীয় আসনে এক এক জন সংসদ সদস্য এখন এক একজন গভর্নরের ভূমিকা পালন করছেন। আইয়ুব মোনায়েম খাঁ দের আচরণকে হার মানাচ্ছে তাদের ভূমিকা। আওয়ামীলীগ এখনও পড়ে আছে পরশ্রীকাতর, হিংসুটে, সন্ত্রাস লালন, হানাহানি ও মিথ্যাবাজির রাজনীতিতে। প্রতিটি এলাকার উপজেলা প্রশাসন ও থানা প্রশাসনকে ব্যবহার করছে নির্লজ্জভাবে আওয়ামীলীগের অঙ্গ সংগঠনের মতো করে। সরকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এমনকি ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ায় অনৈতিক পন্থা অনুসরণ করছে। যা হরহামেশা বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক প্রকাশিত। স্বাধীনতার মূল চেতনা জনগণের ভোটাধিকারও এখন তাদের ক্ষমতার অধীনে নাকানিচুবানি খাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচনের শেষের স্তরগুলো এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের নমুনা এ দেশের জনগণ স্বচক্ষে দেখেছে। নূতন করে পুরো দেশটাকে আওয়ামীকরণ করার লক্ষে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে করার শতভাগ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। অথচ জনগণের দাবী হচ্ছে স্বচ্ছ স্বাধীন প্রশাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গড়ে তোলা। ঐদিকে বর্তমান সরকারের কোন দৃষ্টিই নেই। বরং বর্তমান সরকার তাদের ইচ্ছাকেই জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে উন্নয়নের নামে। উন্নয়ন সবাই চায়। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুধু উন্নয়নের জন্য হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের পিছনে ছিল মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে সকলের সম অধিকার লাভের আশা। সরকার নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত ও একদলীয় করতে যখন যেমন ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। যা মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা নয়। ৭ নভেম্বর দেশকে স্বাধীনতার মূল চেতনায় ফিরিয়ে এনেছিল। আজও সেই চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে উদার গণতান্ত্রিক একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিতে এগিয়ে আসা আমাদের দরকার।

আওয়ামীলীগের কথায়ই এখন দেশ চলে। সরকার এবং আওয়ামীলীগ এক হয়ে গেছে। দেশ ও জাতিকে এই একদলীয় স্বৈরশাসন থেকে পুনরায় বাঁচাতে হলে সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে এক হয়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। ৭ নভেম্বরের চেতনা বহুদলীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে। বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, ফ্যাসিবাদ, পরমুখাপেক্ষিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অন্যতম বিপ্লব ছিল ৭ নভেম্বর। কাজেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তি একমাত্র জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব। আমাদের প্রত্যেককে এই বিষয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসা দেশপ্রেমেরই পরিচয় বহন করবে।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক কর্মী

০১৮১৫৯৪৭২৯৬