মহিউদ্দিন মুকুল :

মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চি আরাকান সমস্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনার জন্য জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। এ কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আগস্টের শেষ সপ্তাহে পেশ করা হয়। এটি কফি আনান রিপোর্ট নামে আন্তর্জাতিক পরিচিতি অর্জন করে। প্রতিবেদনটি রচনার সময় কমিশনকে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছিল ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। এর পরিবর্তে ‘আরাকানি মুসলমান’ অথবা ‘বাঙালি’ ব্যবহার করতে হবে। এ থেকেই বোঝা যায় মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নামে কোনো জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করে না। মিয়ানমারে ৩০টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে। অথচ এ তালিকায় রোহিঙ্গাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। একটি দেশে ৩০-৪০ লাখ মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার ভয়ঙ্কর ধরনের অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারে যে নাগরিকত্ব আইন প্রচলন করা হয়, সেখান থেকে তাদের নাগরিকত্বের অধিকার সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া হয়। ফলে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে পরবাসীতে পরিণত হয়।

পৃথিবীতে যতসংখ্যক রাষ্ট্রহীন নাগরিক আছে, তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এক-সপ্তমাংশ। রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। তারা পাসপোর্ট পায় না, ফলে ভিসাও পায় না। এদের বেশ ক’বার বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ফলে তাদের জীবন হয়েছে আরও দুর্বিষহ। ১৯৭৮, ১৯৯২ ও ২০০৫ সালে এদের অনেককে ফেরত নেয়া হলেও এবার যে চার লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার সরকারের গণহত্যা ও জাতিগত নিধন থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে, তারা আদৌ স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে কিনা অথবা কবে নাগাদ ফিরতে পারবে তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার প্রথমদিকে এদের গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করলেও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্রোত দেখে চুপ থাকতে পারেনি। সব অসুবিধা সত্ত্বেও মানবিকতার দাবিকে প্রাধান্য দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এসব মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। অনেক নারী মাইলের পর মাইল হাঁটাপথে সন্তান প্রসব করেছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহত পিতা-মাতাকে হারিয়ে অনেক শিশু এতিম সন্তানে পরিণত হয়েছে। এদের মধ্যে বহু অবোধ শিশু রয়েছে, যারা তাদের পিতৃ-মাতৃ পরিচয় সম্পর্কে বলতে পারে না। বলতে পারে না তাদের মূল আবাসস্থল কোথায় ছিল। অন্যদিকে চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এসেছে অন্যদের কাঁধে ভর করে। গুলিতে আহত অনেকে পথিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। কেউ কেউ কোনোরকমে নাফ নদী পার হতে পারলেও বাংলাদেশের প্রান্তে এসে মৃত্যুবরণ করেছে। আহতদের অনেকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছে। অনেকের মৃত্যু হয়েছে নৌকাডুবির ফলে।

আরাকানে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। স্যাটেলাইট ইমেজে আগুন জ্বলার দৃশ্য ধরা পড়েছে। অং সান সু চি তার ভাষণে দাবি করেছেন আরাকানের ৫০ শতাংশ গ্রাম এখনও টিকে আছে। তার এই বক্তব্যে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে, ৫০ শতাংশ গ্রামের অস্তিত্ব আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে গেছে। যদি কোনোরকম আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ফলে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরতে পারে, তাহলে এরা কোথায় মাথা গুঁজবে তা কেউ বলতে পারে না। এদের পুনর্বাসনের জন্য শত শত কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। শুধু ঘরবাড়ি নয়, সংসারের আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, চাষাবাদের যন্ত্রপাতি এবং হালচাষের পশুসহ সব ধরনের সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে। নতুন করে জীবনযাত্রা শুরু করার জন্য ছোটখাটো মার্শাল প্ল্যানের প্রয়োজন হবে। শুধু জীবন-জীবিকার সংস্থান নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়। এদের হারানো সম্মান প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দিতে হবে নাগরিকের পূর্ণ মর্যাদা। এর কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? যে দেশের সরকার একটি হাজার বছরের পুরনো জাতিগোষ্ঠীর নামই শুনতে পারে না, তারা রাত পোহালে এদের পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এর জন্য প্রয়োজন ইস্পাতকঠিন জাতীয় ঐক্য। কোনো জাতির মধ্যে বিভেদ থাকলে অন্য দেশগুলোও সে জাতির কথায় কান দেয় না।

প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বিএনপির সঙ্গে কোনো ঐক্য নয়। দল হিসেবে বিএনপির হাজারও রকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারে না এ দলটির প্রতি দেশের ৩০-৪০ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে। এতগুলো মানুষকে হিসাবের বাইরে রেখে বিদেশি শক্তিগুলোর সঙ্গে দেনদরবার ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যে যাই বলুক না কেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে ইতিমধ্যেই সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে একটা ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলের ঐক্যের বিষয়টি নাকচ করে দিলেও বিএনপিকে বারবার ঐক্যের দাবি জানাতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যে রণকৌশল তৈরি হয়, সেটি আলাপ-আলোচনাহীন রণকৌশলের চেয়ে শ্রেয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, বৃহৎ দলগুলোর ‘একলা চলো’ নীতি জাতীয় সংকটে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠে।

এবার রোহিঙ্গা জাতির শত শত বর্ষব্যাপী অস্তিত্বের ইতিহাসের ওপর আলোকপাত করা যেতে পারে। বর্তমানে আরাকান মিয়ানমারের অংশ। অতীতে আরাকান স্বাধীন ছিল। প্রাচীনকালে আরাকান দুটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এর একটি অংশ ছিল দক্ষিণ আরাকান বা সান্দোওয়ে, অন্যটি উত্তর আরাকান বা মূল আরাকান। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এ দুই অংশ সংযুক্ত হয় এবং ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকে। একই সালে আরাকান রাজ্যটি বার্মা বা মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত হয়। আরাকান রাজ্যের বিস্তৃতি বিশ হাজার বর্গমাইলজুড়ে। পার্বত্য আরাকান জেলা এবং সর্ব দক্ষিণের আরাকান আলাদা করার পর আরাকানের আয়তন হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে চৌদ্দ হাজার দু’শ বর্গমাইল। আদমশুমারি না হওয়ার ফলে জনসংখ্যার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। অনুমান করা হয় এই সংখ্যা ৪০ লাখের মতো হবে, তবে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে হিসাবের বাইরে রাখতে হবে। যাদের আরাকান থেকে ১৯৪২-এর পর বিতাড়িত করা হয়েছে। বর্তমানে আরাকানে মুসলমান ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সমান। বৌদ্ধের সংখ্যা ২০ লাখ এবং মুসলমানের সংখ্যা ১৮ লাখ এবং বাকি ২ লাখ সর্বপ্রাণবাদী, হিন্দু ও খ্রিস্টান।

আরাকান নামটি আরাকান রাজ্যের আধুনিক নাম। প্রাচীনকালে এ রাজ্যটিকে বলা হতো রাখাইংগ। কর্নেল এপি ফেইরির মতে আরাকান একটি প্রাচীন গোত্রের নাম। তিনি এ গোত্রটি পেগুতে খুঁজে পেয়েছেন। মুসলিম লেখকরা একে বলতেন রাখাং অথবা আরখাং। সুলতান সামসুদ্দিন গাজীর (৯৬২ হিজরি/১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ) টাঁকশালের নাম ছিল আরাকান। মুদ্রায় প্রাপ্ত টাঁকশালের নামটি যদি সঠিক হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে ষোড়শ শতাব্দীতেও আরাকান নামটি প্রচলিত ছিল। আরাকানের রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করে আরাকান নামটি এসেছে আরবি শব্দ আল্ রেকাং অথবা আল-রুকন থেকে। তুর্কি নৌ-সেনাপতি সিদি আল-রীস এই স্থানকে বলতেন রাকাঞ্জ। বাংলা পুঁথি সাহিত্যে রোসাঙ্গ ও রোকাম- এই দুই শব্দ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কিন্তু রোসাঙ্গ নামটি অনেক বেশি জনপ্রিয়। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা এ স্থানটির নাম দেয় আরাকান এবং তাদের মানচিত্রে দেশটির নাম উল্লেখ করা হয় আরাকান। সুতরাং বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুরনো রাখাইংগ নামটি পরিবর্তিত হয়ে রাখাঙ্গ হয় অথবা মুসলিম লেখকদের লেখায় হয় আরখাঙ্গ। এরও পরে এটি হয় আরাকান। আরাকান রাজ্যের শেষ রাজধানী ছিল মোহঙ্গ (মারুক-উ)। বাঙালি কবিরা মোহঙ্গকে রোসাঙ্গ বলতেন। স্থানীয় আরাকানি এবং চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের মুখে এটি উচ্চারিত হয় রোহাঙ্গ। অর্থাৎ ‘সা’ হয়ে গেল ‘হা’। এ থেকেই জনগোষ্ঠীর নাম হল রোহাঙ্গী অথবা রোহিঙ্গা। সপ্তদশ শতাব্দীতে মুসলিম কবি, বিদ্বান ব্যক্তি, আধ্যাত্মিক পুরুষ এবং প্রশাসকদের অবদানের ফলে আরাকান গৌরবের শিখরে পৌঁছে যায়।

সমকালীন আরাকান সাহিত্যকেও বর্তমান যুগে ইতিহাসের উপাদান গণ্য করা হয়। কবি আলাওল লিখেছেন :

নানা দেশী নানা লোক

শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ

আইসন্ত নৃপ ছায়াতল।

আববী, মিছবী, সামী

তুরুকী, হাবসী, রুমী,

খোরাছানা উপবেগী সালা॥

লাহুরী, সুলতানী, সিন্ধি

কাশ্মীরী, দক্ষিণী, হিন্দী

কামরূপী আব বঙ্গদেশী।

অহপাই, খোটনচারী (?)

কর্ণালী, মলয়াবারী

আচি, কুচি, কর্ণাটক, রাসী

বহু শেখ, ছৈয়দজাদা

মোগল পাঠান যোদ্ধা

রাজপুত হিন্দু নানা জাতি।

কবি আলাওলের কবিতাংশটি থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের রক্তে ঘটেছিল নানা জাতির মিশ্রণ। এর ফলে নানা সংস্কৃতিরও মিশ্রণ ঘটেছে। সুতরাং রোহিঙ্গাদের কেবল বাঙালি বলে মিয়ানমার সরকার যে দাবি করেছে, সেটি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কবি আলাওল আরাকান রাজদরবারে যথেষ্ট সম্মান ও প্রতিপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আজ রোহিঙ্গাদের যেভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার মূলে রয়েছে জাতি নিধনের আগ্রাসী মনোভাব।