বিদেশ ডেস্ক:
রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত জাতিগত নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে দৃশ্যত সোচ্চার হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। শুক্রবারও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রাখাইনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একদিন আগে (বৃহস্পতিবার) দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানান সংস্থাটির মানবাধিকার কমিশনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। ওই বৃহস্পতিবারেই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে ফোন করে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম খবর দিয়েছে, চাপ বাড়াতে মার্কিন আইনপ্রণেতারাও নানামুখী পদেক্ষেপ নিয়েছেন। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের উদ্যোগে তৈরি করা মিয়ানমারবিরোধী খসড়া প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের চেষ্টায় কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। এদিকে চাপের মুখে সহিংসতা কবলিত রাখাইন থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছে মিয়ানমার। রাখাইনে মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে তারা।

শুক্রবার প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্ত দল রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিপন্নতা দেখতে এক সপ্তাহ বাংলাদেশে অবস্থানের শেষদিনে তদন্ত দলের তিন সদস্য জানান, এ ঘটনায় তারা ‘গভীরভাবে মর্মাহত’। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মিশনের প্রধান ইন্দোনেশিয়ার মারজুকি দারুসমান বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। আমরা উত্তর রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে বাস করা অনেক লোকের ঘটনা শুনেছি। তারা বলেছে, পরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে সেখানে কীভাবে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।’ মিশনের আরেক সদস্য শ্রীলংকার রাধিকা কুমারাসোয়ামি জানান, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা ও নৈরাশ্য দেখে তিনি মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। মিশনের অন্য সদস্য অস্ট্রেলিয়ার ক্রিস্টোফার ডমিনিক সিডোটি।

একদিন আগে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে খোলামেলাভাবেই সু চির প্রতি তার অসন্তোষ ব্যক্ত করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার তদন্ত কর্মকর্তা ইয়াংহি লি। রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির ভূমিকাকে ‘উদাসীন’ আখ্যা দিয়ে তীব্রু সমালোচনা করেন তিনি। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিষয়ে সু চির প্রতিক্রিয়াকে তিনি নিস্পৃহ বা নির্বিকার আখ্যা দিয়ে গভীর হতাশা ব্যক্ত করেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির অবস্থানে ‘হতভম্ব’ হয়ে গেছেন বলেও মন্তব্য করেন।
রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তা লি মিয়ানমারের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও শত্রুতা এত তীব্র যে কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলারও সাহস পায় না। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার ঘটনা ঘটছে তা দেশটির সংবাদমাধ্যমে স্থানই পাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘এ ইস্যুতে অং সান সু চির কোনো অবস্থান না নেয়াটা আমাকে এবং সবাইকেই বিমূঢ় করে দিয়েছে। রোহিঙ্গা নামে যে কিছু মানুষ আছে তিনি সেটিও স্বীকার করছেন না। এতে আমি খুবই হতাশ।’

একইদিন বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হদ্মাইংকে রাখাইনে চলমান নৃশংসতা বন্ধ করতে বলেন। মিয়ানমারের সিনিয়র এই জেনারেলকে টিলারসন বলেন, চলমান সংকটে গৃহ ছাড়তে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে সে লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকারকে সহায়তা করতে হবে। একই সঙ্গে টিলারসন মানবিক সহায়তা ও সংবাদমাধ্যমের অবাধ গ্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে সেনাপ্রধানের পদক্ষেপ দাবি করেন। পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের পূণাঙ্গ তদন্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের আহ্বান জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা রাখাইনের ঘটনাপ্রবাহকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বিবেচনা করার কথা ভাবছে। এরই মধ্যে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। গত ৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে শুনানিতে কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য ও কর্মকর্তা রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে সু চি সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ অথবা সহায়তা বন্ধের মতো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

এদিকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের করা ছয় পৃষ্ঠার খসড়া প্রস্তাব নিয়ে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান সেনা সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ ও বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার জোর দাবি জানানো হয়েছে। এতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের কথা নেই। তা সত্ত্বেও কূটনীতিকরা মনে করছেন, এবারের প্রস্তাবও চীনের কঠোর বিরোধিতার মুখে পড়বে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বৃহস্পতিবারই রাখাইনের মংডু ও বুদিডং শহর থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাংয়ের কার্যালয় জানায়, রাখাইনের মংডু ও বুদিডং শহরে ক্লিয়ারেন্স অভিযানে সেনাবাহিনীর কয়েকটি দলকে প্রত্যাহার করা হবে। সেনাপ্রধানের কার্যালয় জানিয়েছে, রাখাইন থেকে তাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না। তারা কেবল দুই এলাকা ছেড়ে রাজ্যের প্রধান শহর সিত্তেতে অবস্থান করবে। সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে এর বেশি কিছু জানানো হয়নি।

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনাবাহিনী নতুন করে নৃশংস অভিযান শুরু করে। এর পর থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এসব শরণার্থী শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনী, স্থানীয় বৌদ্ধ, আধা-সামরিক বাহিনী নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অঘ্নিসংযোগ চালাচ্ছে। সেখান থেকে যারা এখনও পালিয়ে আসতে সক্ষম হননি তারা ক্ষুধা-অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত সংকটের ভয়াবহ মানবিক বিপর্জয়ের মুখোমুখি আছেন। শুক্রবার বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, রাখাইনে নতুন করে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করতে জাতিসংঘকে সবুজ সংকেত দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এর আগে সরকারের অসহযোগিতার মুখে সেখানে দুই মাসের জন্য খাদ্য, পানীয় ও জরুরী ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় জাতিসংঘ।

জেনেভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মুখপাত্র বেট্টিনা লুয়েশের বলেন, মিয়ানমারের সংঘাতকবলিত রাখাইন রাজ্যে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি শুরুর ব্যপারে দেশটির কর্তৃপক্ষ সবুজ সংকেত দিয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ত্রাণ তৎপরতা পুনরায় চালু করতে কতদিন সময় লাগতে পারে বা এ কর্মসূচি কতদিন চলবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানাননি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’র এ কর্মকর্তা। তিনি জানিয়েছেন, বিষয়টি এখনও পর্যন্ত আলাপ আলোচনার মধ্যে রয়েছে। কারণ, সেখানে কী ঘটছে সেটা আমাদের আগে জানতে হবে। ঘটনাস্থলে না গিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।