হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী :
রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি-গর্জনিয়া সড়ক দিয়ে, রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নে ঢুকার পর তিন কিলোমিটার দূরবর্তী জঙ্গলঘেরা শাহমোহাম্মদ পাড়ায় দেশের খাটো ব্যক্তিদের একজনের বাড়ি। সেই বাড়িতে উপস্থিত হয়ে, তাঁকে নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে আঁকা বাঁকা আরও ছয় কিলোমিটারের মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে পৌছি একই ইউনিয়নের বড়বিল গ্রামের বাংলাদেশের সবচেয়ে লম্বা ব্যক্তির বাড়িতে।

এই গল্প তৈরী হয়েছে আলোচিত হামির হামজার ছেলে তরুণ জিন্নাত আলী এবং মৃত বাঁচা মিয়ার ছেলে প্রৌড় জাকের হোছনকে নিয়ে। জিন্নাত ২০ বছর বয়সে উচ্চতায় ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো সে অবিবাহিত। অন্যদিকে ৪৫ বছর বয়সেও জাকের হোছনের উচ্চতা মাত্র ৩ ফুট ৭ ইঞ্চি। কিন্তু ঘর সংসার করেন তাঁর চেয়ে উচ্চতায় দ্বিগুণ হাজেরা বেগমের সঙ্গে। তবে ২০ বছরের সাংসারিক জীবনে তাঁরা এখনো সন্তানের দেখা পাননি। ইতিমধ্যে জিন্নাত আলী এবং জাকের হোছন নানা গণমাধ্যমের শিরোনাম হলেও গত ১৮ অক্টোবর একে অপরকে বাস্তবে দেখেন। এসময় তাঁরা অবাক হয়ে দুজনে কুশল বিনিময় করেন। তাঁদের মধ্যে অন্য কিছুতে ফারাক থাকলেও মিল রয়েছে অভাব-অনটনে।

জকের হোছন বলেন, ‘এতো লম্বা মানুষ যে গর্জনিয়ায় আছে- সেটা শুনেছিলাম। কিন্তু আজ বাস্তবে দেখলাম এবং তাঁর সাথে কথাও বললাম। প্রথমে আমার ভয় হয়েছিল। পরে সেই ভয় কেটে যায়।’ জিন্নাত আলী বলেন, ‘এতো ক্ষুদ্র মানব আমাদের ইউনিয়নে আছে- সেটা জানতাম না। আজ দেখে আমি অবাক হয়েছি।’

জিন্নাত আলী ও জাকের হোছনকে একসঙ্গে অবলোকন করার পর গর্জনিয়া ইউপির এক নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল ইসলাম বলেন, ‘তাঁরা আমাদের গর্ব। তাদের যথাযথ বাঁচায়ি রাখতে সরকারি পৃষ্টপোষকতা দরকার। কারণ তাঁরা একদিন দেশের সম্পদেও পরিণত হতে পারে।’

গর্জনিয়ার মাঝিরকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এসএম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রথম আলোতে সচিত্র সংবাদ প্রকাশের পর সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল জিন্নাত আলীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁকে আর্থিকভাবে সহযোগিতাও করেছেন। ভবিষ্যতেও করবেন। তাছাড়া জাকের হোছনের বিষয়েও তিনি চিন্তাভাবনা করছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।’

জিন্নাত তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তৃতীয়। সবার বড় বোন। তার বিয়ে হয়েছে। বড় আর ছোট দুই ভাইও পড়াশোনা করেননা। তারা দিনমজুরি করেন। জিন্নাত আলীর বড় সমস্যা শারীরিক দুর্বলতা, দুই হাঁটুতে ব্যথা। দারিদ্রের কারণে খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করতে পারেন না। তবে খুব খেতে ইচ্ছা করে তার।

মা শাহফুরা বেগম বলেন, ছেলে লম্বা হওয়ার কারণে খাদ্য জোগানও দিতে হচ্ছে বেশি। শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। মাথায় টিউমার, ডান পায়ে পচন ধরেছে। ডান পায়ের চেয়ে বাম পা দুই ইঞ্চি খাটো। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাও সম্ভব হচ্ছে না। তাদের পরিবারে ভিটে মাটি ছাড়া আর কোন অর্থ সম্পদও নেই। বাবা আমির হামজা বলেন, ছেলে লম্বা হওয়ার কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়াও মুশকিল হয়ে দাড়িয়েছে। রিক্সা, সিএনজি, মাইক্রো, জীপ গাড়িতে বসানো যায় না। বর্তমানে জিন্নাতের শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে।

অন্যদিকে জাকের ছয় ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। একটি ঝুপড়ি ঘরে বউকে নিয়ে জীবন যাপন করেন। বর্ষায় বৃষ্টি পড়লে সেই ঘর ভিজে যায়। তাছাড়া উচ্চতা কম হওয়ায় সব কাজ করতে পারেননা জাকের। তাঁর সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়। এই জন্য সে চন্দ্রঘোনার লালপাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে আর লতা দিয়ে হওর (গরুর মূখে কুলুপ) তৈরী করে। বাজারে এসব বিক্রি করে অল্প টাকা আয় হয়। এর পরও ঘর চালাতে তাঁকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জাকেরের ছোট ভাই জাফর আলম জানান, ‘ভাই-ভাবির সন্তান হচ্ছে না কেন সেটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। ডাক্তার বলেছে তা ব্যায়বহুল।’