হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ:

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে (প্রস্তাবিত নাম রাখাইন প্রদেশ) সহিংসতা বাড়লেও তার কোন প্রভাব পড়েনি শাহপরীরদ্বীপ ক্যাডল করিডোরে। গবাদি পশু আমদানি অব্যাহত রয়েছে। বরং বৈধ এবং অবৈধ পন্থায় শাহপরীরদ্বীপ দিয়ে গবাদি পশু আমদানি আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখাতে সরকার প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব আয় করছে।

টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস সুত্রে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গবাদিপশু আমদানীর জন্য টেকনাফের হ্নীলা ও শাহপরীরদ্বীপ ২টি ক্যাডল করিডোর রয়েছে। তম্মধ্যে হ্নীলা করিডোর দিয়ে কোন গবাদিপশু আমদানী হয়নি। শাহপরীরদ্বীপ ক্যাডল করিডোর দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে মোট গবাদিপশু আমদানী হয়েছে ৯ হাজার ৯৪২টি। এরমধ্যে ৬ হাজার ৯৪৬টি গরু, ৪৩০টি মহিষ, ২ হাজার ৫৬৬টি ছাগল। প্রতিটি গরু ও মহিষ ৫০০ টাকা এবং ছাগল ২০০ টাকা হারে এ খাতে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ৪২ লক্ষ ১ হাজার ২০০ টাকা। যা অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশী।

আগস্ট মাসে মোট গবাদিপশু আমদানী হয়েছিল ১৩ হাজার ২১৬টি। এরমধ্যে ১১ হাজার ৬১২টি গরু, ১ হাজার ৬০১টি মহিষ, ৩টি ছাগল। প্রতিটি গরু ও মহিষ ৫০০ টাকা এবং ছাগল ২০০ টাকা হারে এ খাতে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ৬৬ লক্ষ ৭ হাজার ১০০ টাকা।

জুলাই মাসে মোট গবাদিপশু আমদানী হয়েছিল ৬ হাজার ৬৮০টি। এরমধ্যে ৪ হাজার ৬৭১টি গরু, ২ হাজার ৭টি মহিষ, ২টি ছাগল। প্রতিটি গরু ও মহিষ ৫০০ টাকা এবং ছাগল ২০০ টাকা হারে এ খাতে মোট রাজস্ব আয় হয়েছিল ৩৩ লক্ষ ৩৯ হাজার ৪০০ টাকা।

টেকনাফ শুল্ক কাস্টমস সুপার এএসএম মোশারফ হোসেন বলেন ‘মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের সহিংসতা বাড়লেও শাহপরীরদ্বীপ ক্যাডল করিডোরে তার কোন প্রভাব পড়েনি। নিয়মিত প্রচুর গবাদি পশু আমদানী হচ্ছে। এসব পশু থেকে রাজস্ব আয়ের পর আমদানীকারকগণ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছেন’।

২২ অক্টোবর সরেজমিন টেকনাফ মডেল পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের হাটে দেখা গেছে ছোট-বড়, মাঝারিসহ বিভিন্ন আকারের অসংখ্য গরু উঠেছে। পশু আমদানিকারক শহীদুল ইসলাম বলেন ‘রাখাইন প্রদেশের সহিংসতা বাড়লেও শাহপরীরদ্বীপ করিডোরে এর কোন প্রভাব নেই। প্রায় প্রতি দিনই ট্রলারে করে শত শত গবাদি পশু আমদানি করছি। চলতি বছর মিয়ানমার থেকে আসা এসব বড় বড় পশুগুলো স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় চট্টগ্রাম, ফেনী কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ঢাকায় সরবরাহ করছেন’। গরু ক্রেতা মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন ‘হাটে পছন্দ মতো গবাদি পশুর অভাব নেই। সারা বছর বিক্রির জন্য, চাষাবাদের জন্য এবং মোটা তাজা করে আগামী বছর কুরবানী দেয়ার জন্য ইচ্ছা মত পছন্দের গবাদি পশু কেনা যাচ্ছে’।

এদিকে শাহপরীরদ্বীপ ক্যাডল করিডোরের পাশাপাশি অবৈধ পথে টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গবাদি পশু ঢুকছে। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের প্রভাবে আইন শৃংখলা বাহিনীর নমনীয়তার সুযোগে টেকনাফ সীমান্তের আত্মগোপনে থাকা ইয়াবা চোরাকারাবারীরা এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। সেই সাথে রমরমা বাণিজ্য চলছে রোহিঙ্গাদের গবাদিপশু নিয়ে। ত্রাণের নামে এসব ইয়াবা চোরাচালানী সিন্ডিকেট রোহিঙ্গাদের সাথে মিশে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে তারা ইয়াবা আমদানী এবং রেখে আসা গরু, মহিষ ও ছাগল কৌশলে এপারে নিয়ে আসছেন। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পশু রাতের আঁধারে অবৈধ পথে এনে বাণিজ্য করে অনেকেই অল্প দিনে কোটি টাকা আয় করেছেন বলে জানা গেছে। চোরাই গবাদিপশু ব্যবসা বেশী লাভজনক হওয়ায় সীমান্তের ইয়াবা সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা এবার মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের গরু মহিষ লুটে নিচ্ছেন। অবাধে অনুপ্রবেশের সুযোগে রোহিঙ্গাদের দিয়ে চোরাচালানী সিন্ডিকেট কৌশলে ইয়াবার চালানও নিয়ে আসছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের রিসিভ করতে মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের তোড়জোড় চলছে। মিয়ানমারে সংঘটিত ঘটনা পরবর্তী সে দেশের সেনাবাহিনী এবং পুলিশের অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সহায় সম্বল রেখেই প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা বেসামাল হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অগণিত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন। আরও কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা সীমান্তের ওপারে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে।

মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গা দালাল এবং সেখানকার মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজশ করে নিশী রাতে অবৈধ পথে নিয়ে আসছে শত শত গরু-ছাগল এবং মহিষ। রোহিঙ্গারা ওপারে যেমনি নির্যাতিত হচ্ছেন এপারে এসে ইয়াবা চোরাচালানী সিন্ডিকেটের হাতে গৃহপালিত পশু বিক্রিতে আর বেশী নির্যাতিত হচ্ছেন। মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা এসব চোরাই পশু স্থানীয় ইজারাদারদের সহায়তায় ভূয়া কাগজ বানিয়ে অবাধে বেচা-কেনা করা হচ্ছে। টেকনাফ, শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং, হ্নীলার ফুলের ডেইল, কাষ্টমসঘাট, ওয়াব্রাং, মৌলভীবাজার, নাটমুরাপাড়া, হোয়াইক্যংয়ের খারাংখালী, নয়াবাজার, ঝিমংখালী, নয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, উঞ্চিপ্রাং, লম্বাবিল, তুলাতুলী ও উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা পশু আমদানী করা হচ্ছে। নির্যাতিত বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের রেখে আসা গরু মহিষ ও ছাগল তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীরা মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে ম্যানেজ করে চোরাই পথে নিয়ে আসছে।

গত ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ভোর রাতে হ্নীলার ফুলের ডেইল সীমান্ত দিয়ে এক জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে মিয়ানমারের বেশ কিছু চোরাই পশু নিয়ে আসার পথে বিজিবি ১৯টি মহিষ আটক করতে সক্ষম হলেও অনেক মহিষ তড়িঘড়ি করে সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিয়ে ছটকে পড়ে। পরে আটক মহিষগুলি হ্নীলা কাস্টমস এর কাছে হস্তান্তর করেছিল বিজিবি। মিয়ানমার নাকুরা এলাকার বশির আহমদ ও নুরুল কবির বলেন ‘আমাদের ৪টি পরিবারের ৫২টি মহিষ হ্নীলা এলাকার এক মেম্বার জনৈক রাখাইনকে দিয়ে চুরি করে নিয়ে আসার পথে বিজিবি ১৯টি আটক করে ফেলে। বাকী মহিষ তারা লুটপাট করে। আমরা নির্যাতনের শিকার হয়ে ওপারে রেখে আসা গবাদি পশু এপারের লুটেরাদের হাত থেকে রক্ষায় সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বৈধভাবে নিয়ে আসার ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি’।

এ প্রসঙ্গে টেকনাফ স্থল বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা একেএম মোশারফ হোসেন বলেন ‘মিয়ানমারে সংঘটিত ঘটনার পর থেকে সীমান্ত দিয়ে এক শ্রেনীর লোক অবৈধভাবে চোরাই পশু নিয়ে আসছেন। এ পর্যন্ত আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক কয়েক শত গরু মহিষ কাষ্টমসে জমা দিয়েছে’।

টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাইন উদ্দিন খাঁন বলেন ‘রোহিঙ্গাদের গরু মহিষ ছাগল চুরি করে হোক আর যেভাবে হোক অবৈধপথে নিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহায়তা এবং তাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানী করার অপরাধে এ পর্যন্ত ২ শতাধিক জনকে আটক করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেওয়া হয়েছে।