কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া:
মিয়ানমারে নির্যাতন শিকার হয়ে বেঁচে ফেরা রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে ছোট ছোট ঝুঁপড়ি করে কোন রকম মাথা গোজার ঠাঁই করছিল। ঠিক তখনই বৈরী আবহাওয়ার শিকার হয়ে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে সেসব ঝুপড়ির অনেকাংশ। ফলে আশ্রিত মানুষ গুলোর দূর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।শনিবার সকালেও কক্সবাজারের উখিয়ায় হালকা বৃষ্টি হচ্ছে।
সরেজমিনে কক্সাবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প এলাকায় গিয়ে দুর্ভোগের এমন চিত্র দেখা গেছে। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বৃষ্টির পাশাপাশি নতুন আসা অধিকাংশ রোহিঙ্গা থাকার জন্য তাবু পায়নি। খোলা আকাশের নিচে দিন-রাত পার করছে। পাচ্ছে না ত্রাণ সহায়তাও। বলতে গেলে নতুন আসা অধিকাংশ রোহিঙ্গা অনাহারে। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনেকে কিছু ত্রাণ পেলেও বৃষ্টির কারণে চুলা জ্বলছে না। রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টির কারণে অনেকে মসজিদ ও স্কুলে অবস্থান নিয়েছে। কেউ কেউ বেরিয়ে পড়েছে নতুন ঠিকানার সন্ধানে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের উজ্জ্বল কান্তি পাল বলেন, সাগরের নিম্নচাপটি ক্রমে পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উপকূলের পার্শ্ববর্তী এলাকায় থেকে থেমে ঘন্টায় ৪০কি:মি: বেগে দমকা ও ঝড়ো হাওয়া বইছে। নিম্নচাপের কারণে কোথাও কোথাও কোথাও ১ মি:মি: বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে। সমুদ্রবন্দর সমূহকে তিন নম্বর সতর্কতা সংকেত সহ স্থানভেদে ১ ও ২ নম্বর নৌ-হুঁশিয়ারি সংকেত দেওয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও, সংগঠন ও বাংলাদেশী সহৃদয়বান ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে । তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। নতুন আসা অনেকে দিশেহারা হয়ে ছুটছে এদিক বেদিক। কোথায় গেলে ত্রাণ পাবে। কার কাছে গেলে তার নামটি ত্রাণের জন্য তালিকাভুক্ত হবে। কিংবা একটি টোকেন হাতে পাবে।
দীর্ঘ পথ হেটে আসা অনেকে খেয়ে না খেয়ে দুর্বলতার কারণে মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেছে । খাবার সংকটের পাশাপাশি শুক্রবার থেকে থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিতে ভিজে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের মাঝে বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে। বিশেষ করে খেতে না পেয়ে শিশুদের স্বাস্থ্যহানী এবং বয়স্কদের অনেকে শীতে কাপছে। আবার শ্বাসকষ্টে ভুগছে অনেক বয়স্ক রোগীর যন্ত্রণাও বর্ণনাতীত। স্যাঁতসেঁতে ভেজা মাটি ও কাদার কারণে ঘুমানোর কোন জু নেই ।
বৃষ্টির কারণে ত্রাণ নিতেও পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। খাবারের জন্য ছটফট করছে শিশু গুলো। এর ফলে ব্যাপকভাবে রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টদের। বৃষ্টির কারণে মেডিকেল ক্যাম্প গুলোতে ভিড় করছেন ঠান্ডা-জ্বরে আক্রান্ত রোহিঙ্গারা।
বোঝাই করা ভারের উপর ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছে জাফরের শিশু কন্যা। সে মিয়ানমারের বুচিদং মগনামা এলাকার হারিসানের পুত্র। অনাহারে ৮দিন হেটে শুক্রবার অনুপ্রবেশ করেছে সে। রেজিষ্টার্ড ক্যাম্পের কোথায় জায়গা হয়নি মাথা গোজার। তাই খোলা আকাশের নিচে বসতি। পায়নি ত্রাণ সহায়তা।
বৃষ্টি ভেজা শীতে হাটু বুকে নিয়ে কাপছে মোস্তফা খাতুন (৬৮) ও তার স্বামী সুন্দর মিয়া (৭৫)। তাদের স্থায়ী নিবাস মিয়ানমারের বুচিদং এলাকায়। ১২/১৪ আগে বাড়ী-ভিটে ছেড়ে পাড়ি জমায় নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে। হয়নি এখনো মাথা গোজার ঠাঁই।
একাধিক রোহিঙ্গা জানায়, কোথাও যাওয়ার রাস্তা না থাকায় সারারাত কাঁদা পানিতেই জবুথবু হয়ে রাত কাটিয়েছেন তারা। জোটেনি রাতের খাবারও। ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের স্থান হয়েছে টিভি টাওয়ারের পাশে রাবার বাগান এলাকায় ও রেজিষ্টার্ড ক্যাম্পে খালি জায়গায়। অনেককে গাছের নিচে বসে থাকতে দেখা গেছে। আবার অনেকে ছাতার নিচে শিশুদের বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
অনেক রোহিঙ্গা ব্লক মাঝিদের দোষ দিচ্ছে। তাদের কারণে বিশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ বিতরণের কথা বলেছেন। এছাড়া যারা ত্রাণ পাচ্ছে তারা একাধিকবার পাচ্ছে আর যারা পাচ্ছে না তাদের খোঁজ খবর কেউ নিচ্ছে না। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া অনেক রোহিঙ্গা জানান, পুরনো রোহিঙ্গারা এখন লুটপাটে নেমেছে। এর সাথে স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্ত হাত মিলিয়েছে।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারী, বেসরকারি মেডিকেল টীম সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। তবে প্রকৃতির বৈরি আবহাওয়ার কারণে ঠান্ডা জনিত রোগী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের মধ্যে বয়স্ক ও শিশু রোগীর সংখ্যা বেশি বলেও তিনি জানান।