ডেস্ক নিউজ:
আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপে যোগ দিয়ে বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছে মাঠের রাজনীতির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব জমা দিয়েছেন দল দুটির প্রতিনিধিরা। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দল দুটির এমন বিপরীতমুখিতা অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচনেও সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৫টি প্রস্তাবে বিপরীত মেরুতে তাদের অবস্থান। প্রথমত, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয়ত, বিএনপি চায় নির্বাচনের ৯০ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে। আওয়ামী লীগ চায় সংসদ না ভেঙে নির্বাচন। তৃতীয়ত, ২০০৮ সালের আগের সীমানায় নির্বাচন চায় বিএনপি। অন্যদিকে চলমান সীমানাতেই অর্থাৎ ২০০৮ সালের পর যে নতুন সীমানা নির্ধারিত হয়েছে সেই সীমানাতেই ভোট হোক। চতুর্থত, নির্বাচনের সময় বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে ভোটের মাঠে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে বিএনপি। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন চাইলে বিচারিক ক্ষমতা না দিয়ে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে পারবে বলে প্রস্তাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। পঞ্চমত, বিএনপি নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চায় না আর আওয়ামী লীগ চায় আগামী নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটদান প্রক্রিয়া চালু করা।

তত্ত্বাবধায় সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দীন আমাদের সময়কে বলেন, দুই দলের প্রস্তাব আমরা দেখেছি। এই অবস্থা যদি চলে, নির্বাচনের আগে সংসদ না ভাঙা হয়, সেনাবাহিনী মোতায়েন না করা হয়, তা হলে আমরা ভেবে নিতে পারি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটা নির্বাচন হবে সামনে।
দুই দলের দাবি বিশ্লেষণে একটি বিষয় স্পষ্ট, রাজনীতির মাঠে যেসব বিষয়ে তাদের মধ্যে মতের অমিল ছিল, সংলাপেও তা স্পষ্ট হয়েছে। মূল বিষয়গুলোয় দুই দল আগের অবস্থানেই রয়েছে, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। তা ছাড়া নির্বাচন বিষয়ে এমন কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে; যা ইসির ইখতিয়ারের বাইরে। অর্থাৎ সংলাপে যে রকম পরমার্শমূলক বিষয় উঠে আসার দরকার ছিল, তা আসেনি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল গণভবনে দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সেখানে তারা ইসির সংলাপের বিষয়ে জানান শেখ হাসিনাকে। সব শুনে আবার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে পুনরায় মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গতকাল সচিবালয়ের নিজ কক্ষে আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন যথাসময়ে হবে। সংবিধানে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ীই হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।
অন্যদিকে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, লন্ডন যাওয়ার আগেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সংলাপের বিষয়বস্তু চূড়ান্ত করেন। বুধবার দেশে ফেরার পর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা সংলাপের বিষয়ে বেগম জিয়াকে জানান।
দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বেগম জিয়া দল ও জোটের বৈঠক ডাকবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেওয়ার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হবে।
তবে সংলাপে সিইসির বক্তব্যও বিশ্লেষণ করছেন দলের নেতারা। বিশেষ করে, জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক বলার কারণ অনুসন্ধান করছে দলটি। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি সরকারের নতুন কোনো গেমের অংশ? আর তা না হলে সিইসি কেন এটি বলবেন, তা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে তাদের মনে। কারো মতে, এটি বিএনপিকে খুশি রেখে নির্বাচনে নেওয়ার কৌশল।
বুধবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ইসির সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগের দেওয়া ১১ দফা প্রস্তাব সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি অগ্রহণযোগ্য। ক্ষমতাসীন দলের প্রস্তাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়নি।
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সেনা চায় না, কারণ তারা কারচুপির নির্বাচন চায়। অতীতের যেসব নির্বাচনে তারা সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করেছিল, তার সব নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করেছে; যার প্রমাণও রয়েছে। আমাদের দাবি, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে ভোটের মাঠে সেনা মোতায়েন করতে হবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রস্তাবে আমি নির্বাচন কমিশন নিয়ে গঠনমূলক কোনো বক্তব্য দেখিনি। দুই দল নিজেরা নিজেদের মতো করে কিছু কথা বলে গেছে, এখন ইসি এগুলো নিয়ে কী করবে? ইসির পরিকল্পনা কী? এসব বিষয় জানা গেলে বোঝা যাবে ইসির সংলাপের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে কিনা? তিনি আরও বলেন, আমি দুই দলের আলোচনায় ইসি নিয়ে কোনো বিষয় দেখি না। এখানে ইসির আইন নিয়ে কোনো প্রস্তাব নেই। নির্বাচনকালীন ইসির কোথায় ঘাটতি আছে, সেটি নিয়ে কোনো পরামর্শ দেখলাম না। আবার কিছু বিষয় আছে, যেগুলোয় সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ইসির নিজস্ব এখতিয়ারের বিষয়; সেখানেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের মত দিয়েছে। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি এখনো পরিষ্কার নয়।