ডেস্ক নিউজ:

গ্রেফতার হওয়া জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে তার নিজ জেলা ফেনীতে তৃতীয় ধাপে তদন্ত শেষ করেছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পাঁচ দিনব্যাপী তদন্তে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন ঘটনার শিকার ব্যক্তি, তাদের পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি নিয়েছেন তদন্তকারী কমকর্তা, ট্রাইব্যুনালের সহকারী পরিচালক এএসপি মো. নুরুল ইসলাম। তদন্তের স্বার্থে ওইসব ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের তথ্য কিংবা তদন্ত পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানাতে অপারগতা জানিয়েছেন তিনি। তবে জেলা মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডারসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ধারণা করছেন, মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হবে।
জানা গেছে, গত শনিবার (১৪ অক্টোবর) থেকে শুরু হয় জামায়াত আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তৃতীয় দফার তদন্ত। তদন্তকারী কমকর্তা এএসপি নুরুল ইসলাম পাঁচ দিনের তদন্ত শেষ করে ফেনী ছেড়েছেন বুধবার (১৮ অক্টোবর) সন্ধ্যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে তদন্তে জেলার মানবতাবিরোধী অপরাধের স্থানগুলো পরিদর্শন করেছেন তদন্তকারী কমকর্তা। এসময় তিনি ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। একইসঙ্গে ওইসব অপরাধের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জবানবন্দিও নিয়েছেন।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মীর আব্দুল হান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় ধাপের তদন্ত শেষ হয়েছে। ফেনীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার অন্যতম হোতা এই মকবুল আহমাদ। আমরা ধারণা করছি, তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে শিগগিরই মামলা দায়ের হবে।’
জামায়াত আমিরের বিরুদ্ধে তৃতীয় দফা তদন্ত ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে এএসপি নুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এর আগে ফেনীতে দুই দফায় তদন্ত হয়েছে। তদন্তে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী একটি প্রতিবেদনও ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা ও এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তৃতীয় দফা তদন্তে ওইসব ঘটনার শিকার ব্যক্তি, তাদের পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নিয়েছি।’
এএসপি নুরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘৪৬ বছর আগের এসব ঘটনার অনেক আলামতই খোয়া গেছে। জড়িত অনেকের মৃত্যু হয়েছে। সাক্ষী ও ভুক্তভোগীদের অনেকেও মারা গেছেন। ১৯৭৫ সালের পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্থানের ফলে অপরাধীরা অনেক আলামত নষ্ট করে ফেলেছেন। তবুও আমরা যতটুকু সম্ভব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করছি।’ তবে তদন্তের স্বার্থে ও সার্বিক বিবেচনায় তদন্তে মানবতাবিরোধী ওইসব ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের নাম গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করতে অপারগতা জানান এএসপি নুরুল ইসলাম।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিলেন মকবুল আহমাদ। জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মীর আব্দুল হান্নান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের (১৯৬৭-৬৮ সালের) ভিপি ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ ওয়াজ উদ্দিনকে চট্টগ্রামে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা, দাগনভূঞার জয়লস্করের খুশিপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্যাহকে হত্যা করে লাশ সিলোনিয়া নদীতে ফেলে দেওয়া, একই এলাকার লালপুর গ্রামের পাল বাড়ির ১০ জনকে ধরে নিয়ে জীবিত হত্যার ঘটনাগুলোতে মকবুল আহমাদের নাম জড়িয়ে আছে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজ উদ্দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামীর ফেনী মহকুমা শাখার তৎকালীন আমির ও শান্তি কমিটির অন্যতম নেতা মকবুল আহমাদ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন। একাত্তরের ১০ আগস্ট এক চিঠিতে তিনি ওয়াজ উদ্দিনকে ‘চীনপন্থী মেনন গ্রুপের নেতা’ ও ‘চট্টগ্রাম সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর প্রধান সহকারী’ উল্লেখ করে তার সন্ধান বের করতে ফজলুল হককে অনুরোধ করেন। চিঠিতে লিখেন, ওয়াজ উদ্দিনকে হত্যা করতে ইলিয়াছ, খালেক, জালালসহ তিনি (মকবুল) অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। এ বিষয়ে ‘আগের চুক্তি অনুযায়ী সাহায্য করতে’ ফজলুলকে অনুরোধ করেন মকবুল।’’
অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘মকবুলের ওই চিঠির নির্দেশ মেনেই ১৭ আগস্ট ওয়াজ উদ্দিনকে চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজার এলাকায় থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকেই তার আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলেও তা গত ৪৬ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি।’
দাগনভুঞা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শরিয়তউল্যাহ বাঙ্গালী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় খুশিপুরের মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্যাহ গোপনে তার সাত মাস বয়সী সন্তানকে দেখতে আসেন। যেদিন তিনি বাড়ি আসেন, সেদিন রাত ১২টার দিকে মকবুলের নির্দেশে তাকে সিলোনীয়া ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় রাজাকার মোশাররফ হোসেন মশা। সেখানে তাকে হত্যা করে তার লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আহসান উল্যাহর লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় আরও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া, নারীদের হত্যার মতো ঘটনায় মকবুল আহমাদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলেও দাবি করেন শরিয়তউল্যাহ বাঙ্গালী।
উল্লেখ্য, প্রায় ছয় বছর ধরে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালনের পর গত বছরের ১৭ অক্টোবর দলের আমির হিসেবে শপথ নেন মকবুল আহমাদ। ওই দিনই দিবাগত রাতে ‘জামায়াতের নতুন আমির: ৭১-এর রাজাকার-কমান্ডার, আছে হত্যার অভিযোগও’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে বাংলা ট্রিবিউন। এর পরপরই মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।