সায়ীদ আলমগীর:
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া-টেকনাফ রেঞ্জের প্রায় ৬ হাজার একর বন ভূমিতে রোহিঙ্গারা বসতি গেড়েছে। এসব পাহাড়ের শত শত একর বন এখন ন্যাড়া ভূমিতে পরিণত করেছে রোহিঙ্গারা।

পাহাড়ে একটার সঙ্গে একটা লাগোয়া ঝুপড়ি তৈরি করতে গিয়ে নির্বিচারে গাছ-পালা কেটে ফেলায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাওয়া রাস্তার পাশের পাহাড়গুলো থেকে ঝুপড়ি তুলে দেয়ার পর এই ন্যাড়া পাহাড় দৃশ্যমান হচ্ছে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

স্থানীয় সূত্র মতে, পৃথকভাবে রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফ রেঞ্জের প্রায় ৬ হাজার একর বনভূমি নিজেদের আয়ত্বে নিয়েছে। এসব পাহাড়ে প্রতিদিনই ইচ্ছেমতো নতুন বস্তি তৈরি করছে তারা। ক্যাম্পের ঘিঞ্জির বাইরে গিয়ে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করছে অনেকে।

পুরনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাস্তার পাশের পাহাড়ে ঘর তুললেও ২০১২ সালে ও সম্প্রতি আসা রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাহাড়ে আবাস গড়েছে। ইচ্ছেমতো গভীর বনে ঢুকে বাড়ি করায় নষ্ট হচ্ছে বন্যপ্রাণির আবাসস্থলও।

চলাচল সুবিধার কথা চিন্তা করে অনেকে রাস্তার পাশে সামাজিক বনায়ন করা পাহাড়েই ধাপে ধাপে ঝুপড়ি তুলে। ঘরে শোবার পজিশন তৈরি করতে গিয়ে মাটি সমান ও পরিষ্কার করতে হয়েছে সবাইকে।

ফলে নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে সামাজিক বনায়নে লাগানো গাছসহ বনজ গুল্মজাতীয় দ্রব্য। এ কারণে সহজে ন্যাড়া ভূমিতে পরিণত হয়ে যায় অনেক পাহাড়। কিন্তু ঝুপড়ি থাকা পর্যন্ত পাহাড়ের এই দুরাবস্থা চোখে পড়েনি কারও। কিন্তু রাস্তার পাশের যত্রতত্র ঝুপড়ি তুলে দেয়ার পর দৃশ্যমান হয় পাহাড়ের ন্যাড়া হওয়ার করুণ চিত্র।

রোহিঙ্গা বসতির বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, যে কয়েকটি পাহাড় দখলমুক্ত হয়েছে সেগুলোতে এখন আর সবুজের চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। কেটে ফেলা হয়েছে গাছ। লতাপাতা-গুল্ম কিছুই আর নেই। মাটি কেটে ঘর বানানোর কারণে বদলে গেছে পাহাড়ের আকৃতিও। সবুজ বনাঞ্চল উজাড় হয়ে সেই পাহাড়গুলো এখন পরিণত হয়েছে বিরাণভূমিতে। যেসব পাহাড়ে এখন রোহিঙ্গাদের বসতি আছে সেগুলোতেও চোখে পড়ে না সবুজ গাছপালা।

বালুখালীর বাসিন্দা সৈয়দ আকবর বলেন, রোহিঙ্গারা বসতি গড়ার পাশাপাশি গাছ, লতাপাতা গুল্মজাতীয় বনজ ঝুপঝাড় কেটে সাবাড় করছে। ঘর করতে গিয়ে পাহাড়ের মাটির সাথে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের মূল ও শেকড় তুলে ফেলছে তারা। একের পর এক পাহাড় কেটে ন্যাড়া করছে।

কক্সবাজার বন বিভাগ সূত্র মতে, উখিয়া রেঞ্জে কুতুপালং, থাইংখালী, বালুখালী-১, বালুখালী-২, মধুরছড়া, তাজমিনার ঘোনা, নকরার বিল, সফিউল্লাহঘাটা, বাঘঘোনা ও জামতলীসহ আশপাশের পাহাড় কেটে প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গারা বসতি গড়ে তুলেছে। এছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, হোয়াইক্যং (পুটিবুনিয়া) রেঞ্জের ৫০ একর এবং শিলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, সম্প্রতি আমরা একটি জরিপ সম্পন্ন করেছি। এতে দেখা যাচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফের বালুখালী, তাজমিনার ঘোনা, নকরারবিল, কেরনতলী, পুটিবুনিয়া, বালুখালীরঢালা, কুতপালংয়ের অতিরিক্ত অংশ, শফিউল্লাহ কাটা এবং বাঘঘোনাসহ আরও একাধিক পয়েন্টে প্রায় আড়াই হাজার একরের মতো বনভূমিতে ইতোমধ্যে রোহিঙ্গারা বসতি স্থাপন করেছে।

এর মধ্যে ১৫০০ একরের মতো সামাজিক বনায়ন এলাকা ছিল, যেখানে স্থানীয় দরিদ্র উপকারভোগীদের জন্য বাগান করা হয়। আর বাকি ৯০০ একরে প্রাকৃতিক বন ছিল। এর বাইরে আরও প্রায় ৩০০ একর পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসতি আছে যেগুলো এখন বিরাণভূমি। এখানে তারা কখনও আসছে, কখনও আবার সেখান থেকে চলে যাচ্ছে। এসব পাহাড় থেকে রোহিঙ্গারা প্রতিদিন ৫ লাখ কেজি গাছ পুড়াচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, হঠাৎ করে বানের পানির মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করবে কেউ টের পায়নি, তাই পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে রোহিঙ্গারা যেখানে-সেখানে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেছে। তাদের জন্য কুতুপালং ক্যাম্পের পাশে তিন হাজার একর এলাকা নিয়ে ক্যাম্প করে সাময়িকভাবে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সবাইকে ধাপে ধাপে সেখানে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে যা পূরণ করা অসম্ভব।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব বলেন, রোহিঙ্গারা পাহাড় ও গাছ কেটে যেভাবে ঘর নির্মাণ করেছে, তাতে পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। উঁচু পাহাড়ের উপরের অংশ কাটার ফলে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির। যেসব পাহাড় কেটে ন্যাড়া করা হয়েছে, সেখানে যদি দ্রুত গাছপালা লাগানো না হয়, তাহলে বড় ধরনের পাহাড়ধস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া কি পরিমাণ পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে তা জানতে এখন জরিপ করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে জেলা প্রশাসনের মুখপাত্র খালেদ মাহমুদ বলেন, নিজ দেশে উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গারা মানবিক আশ্রয় পেয়ে উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ের প্রকৃতির উপর নির্বিচারে নির্যাতন চালিয়েছে। এটি নজরে আসায় মানবিকতার পাশাপাশি প্রকৃতি রক্ষায় রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিতে তিন হাজার একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সবাইকে বালুখালীতে নির্ধারিত ক্যাম্পে যেতে হবে। শুধু পাহাড় নয়, নির্ধারিত ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গারা কেউ থাকতে পারবে না। সব রোহিঙ্গাদের নির্ধারিত জায়গায় নেয়ার পর পাহাড়গুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করবে বন বিভাগ।

উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নিজ দেশ মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ।

চলতি বছরের নিপীড়নে গত সোমবার পর্যন্ত প্রায় ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নতুন করে এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। যা স্থানীয় হিসেবে ৭ থেকে ৮ লাখ।