হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ: 

৫ বছরেও জোড়া লাগেনি টেকনাফ-শাহপরীরদ্বীপ। ১০৬ কোটি টাকা বরাদ্দে শাহপরীরদ্বীপে বিধ্বস্থ বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ ১৯ অক্টোবর বৃহষ্পতিবার আনুষ্টানিকভাবে উদ্বোধন করার ঘোষণা দেয়া হলেও গত ৫ বছরেও জোড়া লাগেনি অতি গুরুত্বপূর্ণ টেকনাফ-শাহপরীরদ্বীপ সড়ক। ব্রীজ এবং সড়ক ভেঙ্গে একাকার। সড়ক ও ব্রীজ বিধ্বস্থ হয়ে চষা ভুমিতে পরিণত হয়েছে। ৪০ হাজার মানুষের যাতায়ত মাধ্যম সাঁকো আর নৌকা।

জানা যায়, ২০১২ সালের ১২ জুলাই বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের আঘাতে শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিমপাড়া ও দক্ষিণপাড়া বেড়িবাঁধের একাংশ বিলীন হয়ে গিয়েছিল। শাহপরীরদ্বীপে নতুন করে ভয়াবহ ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। সাগর একে একে গ্রাস করে নিচ্ছে উপকূলীয় এলাকার ঘর-বাড়ি, চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি, মসজিদ-মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্টানসহ বিস্তীর্ন জনপদ। ইতিমধ্যেই অনেকে গৃহহীন ও বাস্তভিটা ছাড়া হয়েছে। এতে আতংকিত হয়ে পড়েছে অসংখ্য পরিবার। অনেক পরিবার তাদের বাড়ি-ঘর ও জমি-জমা হারিয়ে হয়ে পড়েছে নিঃস্ব। দীর্ঘ দিন ধরে সাগরের ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলেও এ পর্যন্ত ভাঙ্গন রোধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় দূর্গতদের মাঝে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। ২০১৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ২০১৩ সালে জলাবায়ু ট্রাস্ট থেকে এ সাগর ভাঙ্গন রোধে প্রায় ৭ কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং সর্বশেষে দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ বরাদ্দ থেকে কয়েক কোটি টাকার ব্লক তৈরী করা হলেও সেগুলো সঠিক ভাবে কাজে লাগানো হয়নি। ঘূর্ণিঝড় কোমেনে এবং ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে নতুন করে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই এ এলাকার সিংহ ভাগ এলাকা এবং ঐতিহ্যবাহী জালিয়াপাড়া জামে মসজিদ পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ, বিদ্যালয়সহ বহু ঘর বাড়ি, আবাদি জমি, গাছ পালা সাগরের গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। রাক্ষুসী সাগর একে একে গ্রাস করে নিচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে শাহপরীরদ্বীপ দু’টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্টানসহ অসংখ্য ঘর বাড়ি। গত ৫ বছরে সাগরের ভাঙ্গনে বিশাল জনপদ সম্পূর্ণ ভাবে সাগরে তলিয়ে গেছে। বর্তমানে শাহপরীরদ্বীপের অনেক বাসিন্দা টেকনাফ ছাড়াও উখিয়া উপজেলার পালংখালী ও কুতুপালং নামক গ্রামের পাহাড়ের পাশে অস্থায়ী ভাবে বসবাস করছে। এ ভাবে দিনের পর দিন শাহপরীর দ্বীপের বিস্তীর্ন এলাকা সাগরে গ্রাস করে নিয়ে যাচ্ছে ।

এরপর স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে একাধিকবার বিধ্বস্থ বেড়িবাঁধ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও কোন সুফল বয়ে আনেনি। ইজিপিপি’র বরাদ্দ এবং ব্যক্তি উদ্যোগেও চেষ্টা কম হয়নি। ভয়াবহ ভাঙ্গণ রোধে কার্যকরী কোন উদ্যোগ না নেয়ায় বাঁধের ভাঙ্গন চরম আকার ধারণ করে। ফলে ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাটসহ দ্বীপের বির্স্তীণ জনপদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। শাহপরীরদ্বীপে স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৪০ হাজার জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। সাগর ও নদীর পানির কারণে হতভাগা মানুষের আক্ষেপ ছিল আবার কি দ্বীপে বেড়িবাঁধ হবে ?

বর্তমান সরকার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপে বেড়ীবাঁধ নির্মাণের জন্য ১০৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। বেড়িবাঁধ ভাঙ্গার টানা ৫ বছর পর ১৯ অক্টোবর বৃহষ্পতিবার বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু করার জন্য টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জাফর আহমদ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর হোসেনসহ বাঁধের ভাঙ্গন স্থান পরিদর্শন করেছেন। নির্মাণ কাজ শুরুর খবরে দ্বীপবাসীর মাঝে স্বস্তি বিরাজ করছে।

দ্বীপের ভাঙ্গন আর প্লাবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চরম ভোগান্তিতে বসবাস যেন নিয়মে পরিণত হয় এ বিচিছন্ন জনপদের বাসিন্দাদের। এসব যারা সইতে পারেননি তারা সাগরে দ্বীপটি বিলীনের আশঙ্কায় ইতোমধ্যে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন। স্থানীয় সূত্র মতে টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের সর্ব দক্ষিণে শাহ্পরীর দ্বীপের অবস্থান। এখানে ১৩টি গ্রাম রয়েছে। এই দ্বীপে ৪০ হাজার জনগোষ্ঠীর বসবাস করলেও বেশীরভাগ লোক অন্যত্রে অবস্থান করেছেন। বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পরপরই সাগরের পানি ঢুকে ঢেউয়ের আঘাতে শাহপরীরদ্বীপ থেকে ডাঙ্গরপাড়া পর্যন্ত সড়কটি বিধ্বস্থ হয়ে যায়। গত ৫ বছর ধরে শাহপরীরদ্বীপবাসীর যাতায়ত মাধ্যম হচ্ছে সাঁকো আর নৌকা। গত কয়েক বছর ধরে এ অবস্থা চলতে থাকায় এলাকাটির নতুন নাম সৃষ্টি হয়েছে ‘শাহপরীরদ্বীপ ভাঙ্গার মুখ’। কিছু অংশ সাঁকো আবার কিছু অংশ নৌকায় করে যেতে হয় শাহপরীরদ্বীপে। কি যে দুঃখ-দুর্দশায় আর ভোগান্তিতে ছিল শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দাগণ তা বলে শেষ করা যাবেনা।

এ দ্বীপের পশ্চিমে সাগর, পূর্বে নাফনদী, দক্ষিণে বদর মোকাম এলাকা বেড়িবাঁধ দিয়ে রক্ষা করা ছিল। এ বাঁধ অরক্ষিত হয়ে সাগরের পানি লোকালয় গ্রাস করছে। ফলে বসতবাড়ি, চিংড়িঘের, ফসলি জমি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এমনকি কয়েক শত বছরের পুরানো কবরস্থান ভয়াবহ ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সাগরে বিলীন হয়ে গিয়েছে। এ অবস্থায় পুরো দ্বীপ সাগরে বিলীনের আশঙ্কা করা হয়েছিল। এবার বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে কিছুতা রক্ষা পাবে বলে আশা করছেন দ্বীপবাসী।

এদিকে ৫ বছর ধরে সাগরের রাহু গ্রাসে নিমজ্জিত শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দাগণ। বর্তমানে মূল-ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। দ্বীপবাসীকে ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় পারাপার করতে হচ্ছে। গত ৫ বছর ধরে চরম ভোগান্তিতে বসবাস করেছেন শাহপরীরদ্বীপের ৪০ হাজার বণি আদম। টেকনাফের সাথে যোগাযোগ রক্ষা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে যাওয়া, গর্ভবতী অসুস্থ রোগীদের টেকনাফে আনা, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের যাতায়ত, আইন প্রযোগকারী সংস্থা সমুহের যাতায়তে ভোগান্তির অন্ত ছিলনা। তার উপর সম্প্রতি লক্ষ লক্ষ মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে এই শাহপরীরদ্বীপ দিয়ে। সাগরের জোয়ারের পানি ঢুকে শত শত বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে যায়। ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে টেকনাফ-শাহপরীরদ্বীপ সড়ক ভেঙে বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। বর্ষায় সাগর পাড়ের মানুষের মাঝে আতঙ্ক লেগে যায়। এমনিতে দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমের তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত রয়েছে। পাশাপাশি জালিয়াপাড়ায়ও ভাঙ্গণ ধরেছে। এনিয়ে লেখালেখি, আন্দোলন, মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশ কম হয়নি।

শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দা অন্যায়ের প্রতিবাদী হিসাবে পরিচিত আবদুল হক প্রকাশ হক সাহেব বলেন ‘৫ বছর পর হলেও সরকার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) শাহপরীরদ্বীপে বেড়ীবাঁধ নির্মাণের জন্য ১০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ায় ব্যক্তিগতভাবে আমি শাহপরীরদ্বীপবাসী খুবই খুশী। এ জন্য বিশ্ব মানবতার নেত্রী শেখ হাসিনা এবং এমপি আলহাজ্ব আবদুর রহমান বদি সিআইপিকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। ইতিপুর্বেও এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ ইস্যু নিয়ে দাবি পেশ এবং যোগাযোগ হয়েছিল। পাশাপাশি দুর্নীতি মুক্ত টেকসই বাঁধ নির্মাণে দেশের গৌরব বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর তত্বাবধানে কাজ বাস্তবায়ন করার দাবি করছি’।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর হোসেন বলেন ‘৫ বছর পর শাহপরীরদ্বীপ বাধঁ নির্মাণে ১০৬ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু করায় সরকারের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। নির্মাণ কাজের কথা শুনে দ্বীপবাসীর মাঝে স্বস্তি বিরাজ করছে’।

শাহপরীরদ্বীপ সাংগঠনিক ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব সোনা আলী বলেন ‘দীর্ঘ ৫ বছর যে কষ্ট নিয়ে আমরা দ্বীপবাসী বসবাস করছি। বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরুর খবরে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে শাহপরীরদ্বীপবাসীর পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। পাশাপাশি ধন্যবাদ জানাই অত্র এলাকার ও কক্সবাজার জেলার ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়া সাংবাদিক ভাইদের প্রতি। তাঁদের লেখনি ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ হচ্ছে জেনে আমরা আনন্দিত, আমরা গর্বিত। এখন আমাদের দাবি হচ্ছে এই কাজটি শক্ত, মজবুত ও টেকসই ভাবে নির্মাণ করা হোক’।

টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জাফর আহমদ বলেন ‘সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বেড়ীবাঁধ নির্মাণের স্থান পরিদর্শন করেছি। ১০৬ কোটি টাকা বরাদ্দে শাহপরীরদ্বীপে বিধ্বস্থ বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ ১৯ অক্টোবর বৃহষ্পতিবার আনুষ্টানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। এলাকার এমপি আলহাজ্ব আবদুর রহমান বদি সিআইপি বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ আনুষ্টানিকভাবে উদ্বোধন করবেন। এরপর টেকনাফ-শাহপরীরদ্বীপ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।