জসিম মাহমুদ,টেকনাফ :

শুধুই রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সাক্ষী হয়ে থাকছে নাফনদ ও সাগর। গতকাল সোমবার ভোরে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম পাড়ার বেড়ি বাধ ভাঙ্গার কাছাকাছি নৌকা ডুবিতে বেচেঁ যাওয়া মোহাম্মদ সেলিম (৪০) দ্বীপের পশ্চিম পাড়ার সাগরের তীরে বাঁলিতে সন্তানদের লাশের পাশে বসে এমনটি বলছিলেন। তিনি জানালেন, ‘মিয়ানমার সেনারা খুব ভয়ানক, হিংস্র পশুর চেয়েও খারাপ। গুলি, জবাই, আগুনে পুড়িয়ে মারছে রোহিঙ্গাদের। এমনকি ছোট বাচ্চাদের আছাড় দিয়ে মেরে ফেলছে। তাদের এই রকম নৃশংস বর্বরতার চেয়ে নাফনদ ও সাগরে ডুবে মরা ভালো। অন্তত লাশগুলো হলে পাওয়া যায়। গতকাল সোমবার ভোরে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম পাড়ার বেড়ি বাধ ভাঙ্গার কাছাকাছি নৌকা ডুবে যাওয়া নৌকাতে বেচেঁ যান সে।

সেলিম বলেন, স্ত্রী রুজিনা আক্তারকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনারা। তাকে দেখার তো দুরের কথা লাশও দেখার সুযোগ হয়নি। তার বাড়ি মিয়ানমার বুচিডং (বুথেডং) টাউনশিপের গুদাম পাড়া এলাকায়। চার সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে দুই ছেলে দুই মেয়ে। এখন তারাঁ চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছে বলে কেদেঁ উঠলেন। আর কখনো ঘুম থেকে উঠবে না। রোহিঙ্গাদের বাঁচতে চাওয়া কি অপরাধ? অর্জিত সব সম্বল ফেলে সন্তানদের নিয়ে জীবন বাচাঁতে এপারে পাড়ি দিয়। শুকেছি এপারে আসতে গিয়ে অনেক লোকজন নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারিয়েছে। তবুও ওপারে সেনাদের মৃত্যুর চেয়ে সাগরে ডুবলে ভাল, তাই চিন্তা করে এপারে পাড়ি দেওয়া। কিন্তু এ বাঁচতে চাওয়াটাও আমার দোষ! নাফনদ ও সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকা ডুবে মরে যাওয়া চার নিথর মৃতদেহ দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি।

তিনি বলেন, গত রোববার বুচিডং পুমালি, গুদাম পাড়া, কোনা পাড়ায় সেনা বাহিনী ও রাখাইনরা মিলে বেশ কয়েকি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেনারা গ্রামে গ্রামে ঢুকে রোহিঙ্গাদের এখনো গুলি ও আগুনে পুড়িয়ে মারছে। এতে লোকজন আবারো মৃত্যুর ভয়ে এদিক-ওদিক পালানোর চেষ্টা করছে। অনেকে গ্রাম থেকে পালিয়ে মিয়ানমার নাইক্ষনদিয়ায় রোহিঙ্গা তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছে। নৌকা ভাড়া না থাকায় এপারে আসতে পারছেনা অনেকেই। সেখানে সবাই কষ্টের দিন কাটাচ্ছে। নাইক্ষনদিয়া এক নৌকা করে ৬৫ জন নাফনদী হয়ে সাগর দিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি দিয়। রাত সাড়ে সাড়ে ৩ দিকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম পাড়ার কাছাকাছি পৌছলে নৌকার গতি কমে দেয় মাঝি। ভেবেছিলাম যাক প্রাণে বেচেঁ পৌছে গেলাম। কিন্তু মাথা উচু করে দেখি সাগরে সাগরে ঢেউ আর শব্দ। নৌকাটি আরও একটু সামনে আগালে পেছন থেকে আসা সাগরে ঢেউ আঘাতে উল্টে যেতে চায়। তখন বাচ্ছাদেরকে জড়িয়ে ধরি। পরে আসা একটি বড় ঢেউয়ের আঘাতে অবেশেষে নৌকাটি ডুবে যায়। এরপর কে কোথায় হারিয়ে যায় জানিনা। এর মধ্যে আমার চার সন্তানের লাশ রয়েছে তারা হলেন- মো. ফয়সাল, মো. বেলাল, শুকতারা ও সখি।

ডুবে যাওয়া নৌকাতে আসা আরও এক দুঃখের কথা শোনালেন হোসন্ আহমেদ (৪০)। তিনি স্ত্রী ও পাচঁ মেয়েকে নিয়ে গত রোববার রাতে মিয়ানমারের নাইক্ষনদিয়া থেকে নৌকায় উঠেছিলেন। অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। বুচিডং টাউনশিপের গুদাম পাড়া। গ্রামে কাঠের দোতলা বাড়ি, তিন একর জমি, গরু, মহিষ-ছাগল এসব ছিল। সব ফেলে গত ১০ দিন আগে নাইক্ষনদিয়া অবস্থান করি। এরপর মোট ৬৫ জন রোহিঙ্গা উঠেছিল ওই নৌকায়। মাঝির নাম ছিল মনজুর তার সঙ্গে ছিল তিন জন মাঝিমাল্লা। নৌকাটি কূলের কাছাকাছি পৌছলে সাগরে ঢেউতে ডুবে যায়। এ ঘটনায় আমি ও স্ত্রী নজিমা বেগম বেঁেচ গেলেও পাচঁ সন্তানের মৃতদেহ ভেসে আসে । শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা কামাল মিয়া বলেন,হোসেন আলী মাঝি নৌকা নিয়ে গতকাল দুই (টিপ) ধাপে নাইক্ষনদিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এসে শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পাড়া সংলগ্ন সাগরের তীরে নামিয়ে দেয়, তাদের কাছ জন প্রতি মিয়ানমার টাকা ৭০ হাজার টাকা নিয়েছে। তারপর আরেক টিপ রোহিঙ্গা নিয়ে তীরে আসার সময় নৌকাটি ডুবে যায়। এই নৌকাটি নিয়ন্ত্রন করেন ওই এলাকার নৌকার মালিক আজগর। নেমে পড়েছেন রোহিঙ্গা পারাপার বাণিজ্যে। অবশ্য এতে জেলেদের যে খুব লাভ হচ্ছে, এমন নয়। লাভের টাকা সব নিয়ে যাচ্ছে এক সময় সমুদ্রপথে মানব পাচারকারী পুরনো এক চক্র।

সোমবার নৌকা ডুবির ঘটনায় সকালে ১১ জন মৃতদেহ ও ২১ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে বলে জানিয়েছেন কোস্টগার্ড শাহপরীর দ্বীপ স্টেশন কমান্ডার লে. জাফর ইমাম শরীফ।