হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ:

‘বালা দেশর মিলেটারী আর ডাকতরর সেবা জীবনত ভুলি নপাইজ্জুম’। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হেলথ ক্যাম্পের ছিমছাম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ক্লিনিকে নিরাপদে ২য় সন্তান প্রসবের পর খুশীতে আটখানা কথাগুলো সদ্য রোহিঙ্গা প্রসূতী রহিমা বেগমের। তার অর্থ হলো ‘বাংলাদেশের সেনা বাহিনী এবং ডাক্তারদের সেবা ভুলার মতো নয়’। সদ্য ভুমিষ্ট জীবিত শিশু পুত্রের মুখ দেখে সাময়িকের জন্য হলেও মিয়ানমারের হৃদয় বিদারক ঘটনা ভুলে যান খুশীতে আতœহারা রোহিঙ্গা দম্পতি।

জানা যায়, এই প্রথম টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পুটিবনিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপদ প্রসব সেবা সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হেলথ ক্যাম্পে সূর্যের হাসি ক্লিনিকের সহযোগিতায় মিয়ানমারের বুচিডং হতে নির্যাতিত হয়ে আসা রোহিঙ্গা নুরুল ইসলামের স্ত্রী রহিমা বেগমের নিরাপদ প্রসব সেবা ১৪ অক্টোবর শনিবার সম্পন্ন করা হয়। রহিমা বেগমের ২য় প্রসবে ছেলে সন্তানের আগমনে যেন সব ভুলে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জন খুশিতে আত্মহারা।

টেকনাফের হ্নীলা মৌলভীবাজার সূর্যের হাসি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক অজয় কুমার চৌধুরী জানান মিয়ানমারের বুচিডং থেকে আসা টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উঞ্চিপ্রাং রইক্ষং এর পুটিবনিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নুরুল ইসলামের স্ত্রী রহিমা বেগম (২০) তীব্র প্রসব ব্যথা নিয়ে সূর্যের হাসি কিøনিক কর্তৃক পরিচালিত স্বাস্থ্য সেবা ক্যাম্পে আসেন ১৪ অক্টোবর বিকালে। তাৎক্ষনিক ক্যাম্পে দায়িত্বরত প্রসব অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সূর্যের হাসি কিøনিকের প্যারামেডিক নুরজাহান বেগম ও সঞ্চিতা চাকমা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হেলথ ক্যাম্পের লেবার রুমে প্রসুতী রহিমা বেগম ভর্তি করানো হয়। এরপর সেনাবাহিনী সদস্যদের সহযোগিতায় বিকাল অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নিরাপদে প্রসব সেবা সম্পন্ন করা হয়।

রোহিঙ্গা নুরুল ইসলাম বলেন ‘মিয়ানমারে চিকিৎসা সেবা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য চিকিৎসা সেবা আরও কঠিন। চিকিৎসা সেবার অভাবে জন্মের সময় প্রথম সন্তান মারা যায়। এরপর সন্তান সম্ভাবা স্ত্রীকে নিয়ে বহু কষ্টে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি। দিন যতই ঘনিয়ে আসে, আমাদের আতংকও বাড়তে থাকে। প্রথম সন্তান মারা যাওয়ায় আতংকিত ছিলাম। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে সুস্থ ও জীবিত সন্তান পাব আশা করিনি। মহান আল্লাহর রহমতে জীবিত সন্তান পেয়ে আমরা খুবই খুশী’।

সূর্যের হাসি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক অজয় কুমার চৌধুরী বলেন ‘বিগত এক মাস ধরে আশ্রিত রোহিঙ্গা গর্ভবতী মা’দের নিরাপদ প্রসব সেবার আওতায় আনতে মূখ্য ভুমিকা পালন করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাঁদের পরিচালনায় স্বাস্থ্য ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর ডাঃ ফেরদৌস রহমান (মেডিকেল অফিসার) কর্তৃক স্বাক্ষরিত ২ অক্টোবর স্মারক নং ২৩.০১.৯১০.১৬০.০১.০৫৭.১০.০১.১০.১৭ মুলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য সূর্যের হাসি ক্লিনিককে বিশেষ অনুরোধপত্র প্রেরন করেন। এর প্রেক্ষিতে সূর্যের হাসি ক্লিনিকের একদল কর্মী নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিদিন আশ্রিত রোহিঙ্গা গর্ভবতী মা’দের নিয়ে গ্রুপ ভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। তাঁরা প্রতিদিন চেকআপ ছাড়াও সপ্তাহে দু’দিন পুষ্টি (চাউল, ডাল, তৈল, আলু ও মশলা) বিতরণ, মাসে দু’দিন ডিম ও রুটি বিতরণ, পরনের থামী কাপড়, স্বামীদের উৎসাহের জন্য লুঙ্গি, ছেলে মেয়েদের জন্য জামা বিতরণ করছে। প্রসব পরবর্তী নবজাতকের জন্য এক ঝুড়ি বিভিন্ন উপহারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে’। তিনি আরও বলেন ‘সরকারী নির্দেশনা মতে সাধারণ স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরকে নিরাপদ প্রসব ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ এবং অস্থায়ী পদ্ধতি সেবা দেয়া হচ্ছে। ৩০ সেপ্টেম্বর হতে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত সূর্যের হাসি কিøনিক কর্তৃক পরিচালিত স্বাস্থ্য সেবা ক্যাম্পে ৯৯৬ জন গর্ভবতী, ১৩৫ জন মা’কে প্রসব পরবর্তী, ২৮০ জন শিশুদের ডায়রিয়া, ১৮৫ জনকে সর্দি কাশি নিউমোনিয়া, ১৮৫ জন রোহিঙ্গা নারীকে পরিবার পরিকল্পনার ডিপো ইঞ্জেকশন, ৯৮ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে খাবার বড়ি ও কনডম এবং ৬১৩ জনকে সাধারন স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়েছে’।

এদিকে টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবায় ১৬টি মেডিকেল টিম রাতদিন কাজ করছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: সুমন বড়–য়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প এবং গ্রামে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা প্রয়োজনের তুলনায় যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন বলে আশ্রিত রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন। গরম এবং হালকা বৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভাইরাস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকলেও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার কারণে রোগ বালাই তেমনটি দেখা যাচ্ছেনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের সেবা দানের লক্ষ্যে টেকনাফে ফিল্ড পর্যায়ে সরকারী উদ্যোগে ৫টি, বেসরকারী উদ্যোগে ১১টি মেডিকেল টীম কাজ করছে। আইন শৃংখলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও সাংগঠনিক ছাড়াও ১৩টি কমিউিনিটি ক্লিনিক, ২টি সাব সেন্টার, ২টি পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ৫০ শয্যার উপজেলা হেলথ সেন্টার, মুচনী এবং লেদা ক্যাম্পে এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের আওতায় ২৯ জন ডাক্তার, ২৭ জন নার্স, ৮ জন স্যাকমো নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া বেসরকারী উদ্যোগে পরিচালিত মেডিকেল টীমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী রোহিঙ্গাদের সেবায় কাজ করছেন।

ক্যাম্প এবং গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সেবায় সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে দিবারাত্রি মেডিকেল ক্যাম্প চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে নিজস্ব ডাক্তার দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে মেডিকেল ক্যাম্প। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উদ্যোগে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সেবায় টীম গঠন করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ ঔষধ এবং কাউন্সিলিং করতে দেখা গেছে। এছাড়া এমএসএফ, আইওএম, ইউনিসেফ, গণস্বাস্থ্য, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিদিন মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত সব ধরণের রোগী সেবা নিচ্ছেন। জটিল এবং কঠিন রোগে আক্রান্ত রোহিঙ্গারা এসব মেডিকেল ক্যাম্প থেকে সেবা নিয়ে সুস্থতা লাভ করছেন বলে জানা গেছে।

টেকনাফের রইক্ষ্যং পুটিবনিয়া অস্থায়ী রোহিঙ্গা শিবিরে স্থাপিত মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসা ৮০ বছরের বৃদ্ধা শামারুপ বলেন ‘দেশে থাকাকালীন চিকিৎসার অভাবে বেশী কষ্টে ছিলাম। রইক্ষ্যং ক্যাম্পে এসে চিকিৎসা নিয়ে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেছি। বর্তমানে আরামে আছি’।

অপরদিকে টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনার পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সচেতনতা এবং উদ্বুদ্ধকরণের ফলে রোহিঙ্গারা অস্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা বিভিন্ন অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে।

কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা উপ-পরিচালক ডাঃ পিন্টু কান্তি ভট্রাচার্য বলেন ‘সরকারী নির্দেশনা মোতাবেক রোহিঙ্গাদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনার পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে ৩ ভাগে ব্যাপকভাবে কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। এ জন্য টেকনাফে ২টি এবং উখিয়ায় ৪টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। দুই উপজেলায় নিয়মিত আগের স্বাভাবিক সেবা দান ছাড়াও রোহিঙ্গাদের সেবায় গঠিত ৬টি মেডিকেল টিম রাতদিন কাজ করছেন। এতে বিভিন্ন উপজেলা থেকে ডেপুটেশনে আনা ৬ জন মেডিকেল অফিসার, ৬ জন উপ-সহকারী কমিউিনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো), ২০ জন এফপিএ দায়িত্ব পালন করছেন। ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নারী জন্ম বিরতি উঞ্জেকশন, রোহিঙ্গা নারী খাবার বড়ি এবং রোহিঙ্গা পুরুষ কনডম গ্রহণ করেছেন। তিনি আরও বলেন ‘বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা পাচ্ছেন’।

টেকনাফ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শ্রুতি পূর্ণ চাকমা বলেন ‘মেডিকেল টীম গঠন করে রোহিঙ্গাদের পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে নিয়মিত কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। ত্রাণ গ্রহণের লাইনে এবং আশ্রয় ক্যাম্পে গিয়ে সরকারী নির্দেশনা মতে কর্মীগণ কাউন্সিলিং করছেন’।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং জন্ম বিরতির কোন ঔষধের সরবরাহ ও ব্যবস্থা নেই। সারা বছর জুড়েই টেকনাফ এবং উখিয়া সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশ থেকে খাবার বড়ি, কনডম ও ইঞ্জেকশন মিয়ানমারে পাচার হত। প্রচুর চাহিদা ছিল এসব সামগ্রীর। চোরাইপথে যাওয়া এসব জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ঔষধ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ চড়া দামে কিনে ব্যবহার করতেন। এখন তারা বাংলাদেশে এসে বিনা মুল্যে হাতের কাছে পেয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: সুমন বড়–য়া বলেন ‘রোহিঙ্গারা প্রয়োজনের তুলনায় যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন। গরম এবং হালকা বৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভাইরাস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকলেও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার কারণে রোগ বালাই তেমনটি দেখা যাচ্ছেনা। রোহিঙ্গাদের সেবা দানের লক্ষ্যে টেকনাফে ফিল্ড পর্যায়ে সরকারী উদ্যোগে ৫টি, বেসরকারী উদ্যোগে ১১টি মেডিকেল টীম কাজ করছে। আইন শৃংখলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও সাংগঠনিক ছাড়াও ১৩টি কমিউিনিটি ক্লিনিক, ২টি সাব সেন্টার, ২টি পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ৫০ শয্যার উপজেলা হেলথ সেন্টার, মুচনী এবং লেদা ক্যাম্পে এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের আওতায় ২৯ জন ডাক্তার, ২৭ জন নার্স, ৮ জন স্যাকমো নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া বেসরকারী উদ্যোগে পরিচালিত মেডিকেল টীমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী রোহিঙ্গাদের সেবায় কাজ করছেন’।