হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ: 

টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে। স্বল্প পরিসরে চলছে টেকনাফ-আকিয়াব সীমান্ত বাণিজ্য। ২৪ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের মংডু শহর থেকে টেকনাফ স্থল বন্দরে সীমান্ত বাণিজ্যের কোন পণ্য আসেনি। ব্যবসায়ীদেরকে মংডু টাউনশীপের কতৃপক্ষ টেকনাফ বন্দরে মালামাল আনতে দিচ্ছেনা। সেই সাথে আমদানী-রপ্তাণীকারকদের যাতায়তও বন্দ রয়েছে। তবে আকিয়াব (সিটওয়ে) থেকে যৎসামান্য পণ্য আমদানী হয়েছে। রপ্তানী বাণিজ্যের চিত্র আরও শোচনীয়। মিয়ানমারের মংডু কতৃপক্ষ একতরফা ও অঘোষিতভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্দ রাখায় রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে বলে জানা গেছে। টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। আগে যেখানে প্রতিমাসেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার পরও কয়েক কোটি টাকা বেশী আয় হত, সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি। এদিকে টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় মংডু টাউনশীপ থেকে পণ্য নিয়ে এসে মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লা টেকনাফ স্থল বন্দরে আটকা পড়েছেন।

জানা যায়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যের এই পয়েন্টটি ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড’ নামে পরিচিত এবং পরিচালিত। ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর টেকনাফ এবং মংডু টাউনশীপে পৃথকভাবে আড়ম্বরপুর্ণ অনুষ্টানের মাধ্যমে আনুষ্টানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেই থেকে উভয় দেশের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বাণিজ্য সম্প্রসার করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রেখে আসছে ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড’। তাছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেকারদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্ত মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সহিংস ঘটনায় আরাকানের কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করলেও দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, সীমান্ত রক্ষা বাহিনী, আইন শৃংখলা বাহিনী সর্বোপরি বাংলাদেশ সেনা বাহিনী সর্বোচ্চ সংযম, ধর্য, কৌশল, দক্ষতা প্রদর্শন পূর্বক পরিস্থিতি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন। যা সারা দুনিয়া জুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্ত মিয়ানমারে সহিংস ঘটনায় বাংলাদেশের পক্ষে কোন প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ করা না হলেও মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় আরাকান রাজ্যের (পরিবর্তিত নাম রাখাইন স্টেট) অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক শহর মংডু অঘোষিত ও একতরফাভাবে টেকনাফ স্থল বন্দরের সাথে সীমান্ত বাণিজ্য বন্দ করে দেয়। এতে টেকনাফ স্থল বন্দর ব্যবহারকারী আমদানী-রপ্তাণীকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট, শত শত শ্রমিক আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পাশাপাশি সরকার প্রতি দিন মোটা অংকের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

১২ অক্টোবর বিকালে সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায় আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য নেই। কিছু ভুষা পণ্য ও কাঠ আসছে মংডুর বাহির থেকে। বন্দরের বহির্নোঙ্গরে জাহাজ জট নেই। শ্রমিকদের কোলাহল নেই। রাজস্ব আয়সহ আমদানী-রপ্তাণীর কাহিল অবস্থা। স্থল বন্দর কাস্টমস সুত্র জানান, আগে প্রতি মাসে প্রায় শত কোটি টাকা মুল্যের পণ্য আমদানী-রপ্তাণী হত। সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে ১৪১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানী হয়েছে মাত্র ২৮ কোটি ৪৭ লক্ষ ২২ হাজার ৬৬২ টাকা মুল্যের পণ্য। এতে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৬৭ লক্ষ ১৬১ টাকা। এ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ১৪ লক্ষ ৯৯ হাজার ৮৩৯ টাকা কম আয় হয়েছে।

রপ্তাণী বাণিজ্যের চিত্র আরও শোচনীয়। আগে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা মুল্যের শতাধিক চালানে বিভিন্ন প্রকারের বাংলাদেশী পণ্য টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে মংডু টাউনশীপে রপ্তানী হত। কিন্ত সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ১৬টি চালানে ৩৭ লক্ষ ৯১ হাজার ৮৯২ টাকা মুল্যের ৭ প্রকারের বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য রপ্তাণী হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ৪টি চালানে ২৫ লক্ষ ৬০ হাজার ৮৩ টাকা মুল্যের ৪৪.৪৮ মেট্রিক টন বাংলাদেশী গেঞ্জি, ৩টি চালানে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার ৯৬০ টাকা মুল্যের ১.৯২ মেট্রিক টন মানুষের চুল, ৩টি চালানে ৯ হাজার ৮১০ টাকা মুল্যের ০.০৮ মেট্রিক টন শুটকি মাছ, ২টি চালানে ৭ লক্ষ ৩ হাজার ৫০ টাকা মুল্যের ৫.৯ মেট্রিক টন ফাইস্যা মাছ, ১টি চালানে ৩০ হাজার ৬৫৬ টাকা মুল্যের ০.৭৫ মেট্রিক টন চিপস, ২টি চালানে ২ লক্ষ ৬৯ হাজার ৭৭৫ টাকা মুল্যের ০.৮২৫ মেট্রিক টন ফিসিপলেটস, ১টি চালানে ৬১ হাজার ৫৫৮ টাকা মুল্যের ১.৫ মেট্রিক টন জুট ব্যাগ।

তবে কুরবানীর ঈদের মাসে হওয়ায় গবাদিপশু আমদানী খাতে আয় ভাল হয়েছে। ঈদের আগে থেকেই দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছিল। সেই সাথে বৈধ ও অবৈধ পথে গবাদিপশু এসেছে প্রচুর। ২ সেপ্টেম্বর শনিবার বাংলাদেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গবাদিপশু আমদানীর জন্য টেকনাফের হ্নীলা ও শাহপরীরদ্বীপ ২টি ক্যাডল করিডোর রয়েছে। তম্মধ্যে হ্নীলা করিডোর দিয়ে কোন গবাদিপশু আমদানী হয়নি। শাহপরীরদ্বীপ ক্যাডল করিডোর দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে মোট গবাদিপশু আমদানী হয়েছে ৯ হাজার ৯৪২টি। এরমধ্যে ৬ হাজার ৯৪৬টি গরু, ৪৩০টি মহিষ, ২ হাজার ৫৬৬টি ছাগল। প্রতিটি গরু ও মহিষ ৫০০ টাকা এবং ছাগল ২০০ টাকা হারে এ খাতে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ৪২ লক্ষ ১ হাজার ২০০ টাকা।

এদিকে টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় মংডু টাউনশীপ থেকে পণ্য নিয়ে এসে মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লা টেকনাফ স্থল বন্দরে আটকা পড়েছেন। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে সহিংস ঘটনার প্রেক্ষিতে এরা ভয়ে গত এক মাসেরও অধিক কাল ধরে স্বদেশে ফিরতে পারছেন না বলে জানা গেছে। মিয়ানমার নাগরিক ৪৪ জনের মধ্যে ৪৩ জনই মুসলমান এবং ১ জন অমুসলিম হিন্দু। এরা সকলের বাড়ি মিয়ানমারের মংডু টাউনশীপের নোয়াপাড়া, উকিলপাড়া, নাপিতের ডেইল, সুধাপাড়া, খাঁরিপাড়া, ফয়েজীপাড়া, মন্নিপাড়া এবং ২ সহোদর বাড়ি বলিবাজার গ্রামে।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে কথা হয় আটকে পড়াদের সাথে। এরা খায়-দায়, বন্দর এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, আর তাঁদের কার্গো ট্রলারে ঘুমায়। এসময় ৪০ জনকে উপস্থিত পাওয়া গেছে। এরা হলেন জামাল হোছন মাঝি (৬০), আরেছ আহমদ (২৩), রফিক আলম (৩০), ইয়ামিন (৩২), গুরা মিয়া (৩৫), ফায়সাল (২০), আবদুল হাকিম (৩৫), হোছন আহমদ (৪০), হোছন আলী (২৭), জিয়াউর রহমান (৩৫), আহমদ হোছন (৩৬), মোঃ জোহার (৪০), হেমন্ত (৪৫), জুবাইর (৩৫), ইলিয়াছ (২৬), পুতু (৩০), জামাল হোছন (২৮), নুর হোছন (২৫), আনিস (২০), মোঃ রফিক (২৫), কামাল হোছন (২৬), রফিক আলম (৪০), নুর হাকিম (২২), কুরবান আলী (২৭), আবদুল হামিদ (৩০), মোঃ জুবাইর (২৬), পুতুইয়া (২৬), নুরুল আলম (২২), মোঃ নুর (৩০), শফিকুল্লাহ (২৫), রাহমতুল্লাহ (৩৫), আবদুল হামিদ (৪০), সালেহ আহমদ (২২), রশিদ আহমদ (৪৫), মোঃ সালাম (৫০), মোঃ হারুন (২৭), রাহমতুল্লাহ (৩০), জামাল হোছন (১৮), মোস্তাক আহমদ (৩৫), জিয়াবুল হক (২৫), রাহমত আলী (২২)। অপর ৩ জন গোপনে এবং বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মিয়ানমারে চলে গিয়েছেন বলে সরেজমিন স্থল বন্দরে গিয়ে আটকে পড়াদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে। উক্ত ৩ জনের নাম-ঠিকানা এবং উপস্থিত পাওয়া যায়নি। আটকে পড়া একমাত্র অমুসলিম হিন্দু রোহিঙ্গা জিতেন্দ্রের পুত্র হেমন্ত (৪৫) গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্যে মাদক সেবনের দায়ে আটক হয়ে বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন।

আটকে পড়া মিয়ানমার নাগরিক মংডু টাউনশীপের নোয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মৃত আমির হামজার পুত্র জামাল হোছন মাঝি (৬০) বলেন ‘আমরা ২৪ আগস্ট সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় মিয়ানমারের মংডু থেকে ১৩টি কার্গো ট্রলারে মালামাল বোঝাই করে ৪৪ জন মাঝি-মাল্লা টেকনাফ স্থল বন্দরে আসি। মালামাল খালাস করে ২৫ আগস্ট মংডুতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। বাণিজ্যের মালামালও যথাসময়ে খালাস হয়েছিল। কিন্ত রাতে সহিংস ঘটনার কারণে ভয়ে দেশে ফিরে যাইনি। আমরা ঈদ উদযাপন করেছি এখানে। যাঁদের কাছে সীমান্ত বাণিজ্যের মালামাল এনেছিলাম, তাঁরা আমাদের রসদপাতি দিচ্ছেন। বন্দর কতৃপক্ষ, কাস্টমস এবং টেকনাফের ব্যবসায়ীগণ আমাদের যথেষ্ট দেখাশুনা করছেন। খোঁজখবর রাখছেন। মোবাইল ফোনে পরিবারের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। কয়েক জনের পরিবার-পরিজন পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে’।

তিনি আরও বলেন ‘আমরা সাধারণ মাঝি-মাল্লা। আমরা যাঁদের মালামাল নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলাম তাঁরা মংডু টাউনশীপের বড় বড় ব্যবসায়ী। তম্মধ্যে মুসলমান এবং রাখাইন উভয়ে রয়েছেন। তাঁরা মংডু এলাকার ধনী লোক। তাঁরা আমাদেরকে মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন বিষয়টি লিখিতভাবে উর্ধতন কতৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্ত এখনও রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্ট আসলে এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে স্বদেশে ফিরে যাব’।

টেকনাফ স্থল বন্দরের জিএম জসিম উদ্দিন বলেন ‘আকিয়াব থেকে কিছু পণ্য আসছে। ২৪ আগস্টের পর মংডু থেকে কোন পণ্য আসেনি। কবে আসা পুনরায় শুরু হবে তারও কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছেনা। তাছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে টেকনাফ স্থল বন্দরের ইমিগ্রিশন শাখা বন্দ রয়েছে। মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লা ২৪ আগস্ট থেকে আটকে পড়া নিশ্চিত করে বলেন ‘বিষয়টি উর্ধতন কতৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। তবে আগামী কিছু দিনের মধ্যে মংডু থেকে মালামাল আসা শুরু হবে বলে শোনা যাচ্ছে’।