ডেস্ক নিউজ:

একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন মো. সোহেল হোসেন। মাস শেষে কোম্পানি থেকে বেতন-ভাতা সবকিছু মিলিয়ে পান ১৪ হাজার টাকা। এর বাইরে তার বাড়তি আয়ের আর কোনো সুযোগ নেই। এ টাকা দিয়েই চার সদস্যের পরিবারের সংসার খরচ চালাতে হয় সোহেলকে। চাল, সবজিসহ নিত্য পণ্যের যে দাম তাতে প্রতিমাসেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। আর সাম্প্রতিক সময়ে চাল, সবজির লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখিতায় অনেকটাই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা সোহেলের।

তিনি জানান, যাত্রাবাড়ির একটি একটি টিন শেডের বাড়িতে দুই রুম ভাড়া নিয়ে থাকেন। প্রতিমাসে বাসা ভাড়া দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। চাল কিনতে লাগে ২ হাজার টাকার ওপরে। ছেলে ও মেয়ের লেখাপড়ার পেছনে খরচ হয় ১ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়েই তাকে মেটাতে হয় সারা মাসের বাজার খরচসহ (চাল বাদে) অন্যান্য খরচ। ফলে সকাল-সন্ধ্যা অফিস করে যে টাকা পান তা দিয়ে ভালো মতো সংসার চালানোই দুষ্কর। এ পরিস্থিতিতে ছেলে-মেয়ে কোন অবদার করলে অধিকাংশ তা পূরণ করা সম্ভব হয় না।

বেসরকারি এই কর্মকর্তা বলেন, আমার ছেলে ক্লাস থ্রিতে এবং ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বাচ্চা ছেলে মেয়েরা প্রায় বিভিন্ন বায়না ধরে। ভালো খাবার খেতে চায়। ওরা তো আর বোঝে না আমার সামর্থ্য। কিছুদিন আগে ছেলে-মেয়ে দু’জনই বায়না ধরল শিশু পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সামর্থে না কুলানোর কারণে তাদের সেই আবদার রাখতে পারিনি। অনেক বুঝিয়ে তাদেরকে শান্ত করি।

তিনি আরও বলেন, যে বেতন পায় তা দিয়ে এমনিই টানাটনি করে সংসার চলে। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি চাল ও সবজির যে দাম বেড়েছে তাতে সংসার চালানো বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। দুপুরে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। বেশি খুদা লাগলে মাঝে মধ্যে দোকান থেকে রুটি কিনে পানি দিয়ে ভিজিয়ে খায়। দুপুরে ভাত খায়না এ কথা বাসায় কখনো বলিনি। কিন্তু অফিস শেষে মলিন মুখে বাসায় ফিরলে ও (স্ত্রী) বুঝে যায় দুপুরে কিছু খায়নি। আমার ধারণা দুপুরে ছিলে-মেয়ের মুখে কিছু খাবার তুলে দিলেও ও প্রায় সময় না খেয়ে থাকে।

শুধু মো. সোহলে নয় রাজধানীতে বসবাস করা একটি বড় অংশেরই জীবনযাত্রার চিত্র এটি। দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতিতে মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার নিচে থাকা রাজধানীবাসীর অধিকাংশই এখন ভালো নেই। ঢাকা শহরে ২০ হাজার টাকা নিচে মাসিক আয় ঠিক কতো এর সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বর্তমানে ঢাকাতে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। এর বড় অংশেরই আয় ২০ হাজার টাকার নিচে।

শুধু ঢাকা শহরে একটি অংশ নয় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে দেশের অসংখ্য মানুষের। বর্তমানে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে ৩ লাখের ওপর শ্রমিক রয়েছেন যারা ন্যূনতম মজুরিভুক্ত। যাদের বেতন ১০ হাজার টাকার নিচে। এসব শ্রমিকদের অধিকাংশেরই প্রতিদিন এক বেলা অনাহারে কাটাতে হয়। আর সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের সেই কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ- ২০১০ অনুযায়ী, খানা প্রতি মাসিক জাতীয় গড় আয় ১১ হাজার ৪৮০ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয়ের পরিমাণ ১১ হাজার ২০০ টাকা। ২০০৫ সালে খানা প্রতি আয় ও ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ২০৩ টাকা ও ৬ হাজার ১৩৪ টাকা। এই হিসেবে ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১০ সালে আয় বাড়ে ৫৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ব্যয় বাড়ে ৮২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

২০১০ সালের পর বিবিএস থেকে আর কোন খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১০ সালে যে হারে আয় ও ব্যয় বৃদ্ধি পায়, সেই হার ধরলে বর্তমানে খানা প্রতি মাসিক আয় অনুমানিক ২০ হাজার টাকার নিচে। অপরদিকে খানা প্রতি মাসিক ব্যয়ের পরিমাণও প্রায় ২০ হাজার টাকা।

এদিকে বর্তমানে দেশে দারিদ্রের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ- ২০১০ অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে দারিদ্রের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে। তার আগে ২০০৫ সালে এই হার ছিল ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে প্রতি পাঁচ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ১০ শতাংশ হারে দারিদ্রের পরিমাণ কমেছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৬ টাকা কেজি। মোটা চালের দাম ৫০ টাকার ওপরে। খোলা আটার কেজি ২৮ থেকে ৩০ টাকা। চাল, আটার এমন দামের সঙ্গে কাঁচাসবজির দামও বেশ চড়া। রাজধানীর বাজারগুলোতে ৬০ টাকা কেজি দরের নিচে কোনো সবজি পাওয়া এখন দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঁচা মরিচের দামও ছুঁয়েছে ২০০-২৫০ টাকা কেজি।

এক বীমা কোম্পানিতে অফিসার পদে কাজ করেন শাহিনা আক্তার। তার স্বামীও বীমা কর্মী। দুজনের আয়ে ঢাকা শহরে এক ননদ ও এক ছেলে নিয়ে চারজনের সংসার তাদের। শাহিনা আক্তার বলেন, আমরা দু’জনে যে আয় করি তা দিয়ে কোন রকমে আমাদের সংসার চলে। ননদ হাইস্কুলে পড়ে। ছেলে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। সংসারের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে মাস শেষে কোনো টাকা উদ্বৃত্ত থাকে না। যা আয় হয় তার সবই সংসার চালাতে ব্যয় হয়ে যায়। হিসাব করে খরচ করেও গত মাসে (সেপ্টেম্বরে) এক কলিগের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করতে হয়েছে। বর্তমানে দ্রব্য মূল্যের যে দাম তা অব্যহত থাকলে হয় তো সামনে একবেলা খাওয়া বন্ধই করে দিতে হবে।

যাত্রাবাড়ি চাল আড়তের বিক্রেতা মো. আলাউদ্দিন বলেন, বর্তমানে চালের যে দাম বাড়েছে আমার ২০ বছরের ব্যবসায় এমন চিত্র কখনো দেখিনি। ৬ মাস আগেও যারা ৫০ কেজি চালের বস্তা কিনতে এখন তারা ২০ থেকে ২৫ কেজি করে চাল কিনছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে মোটা চলের বস্তার পরিমাণ কমিয়ে ২৫ কেজিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। আগে কখনো মোটা চল ৫০ কেজি নিচের বস্তা বিক্রি হয়নি। শুধু মিনিকেট ও বাসমতি চাল ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি করা হতো। কিন্তু ক্রেতাদের চাল কেনার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে মোট চালও ২৫ কেজি বস্তা করতে বাধ্য হয়েছেন।