ডেস্ক নিউজ:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাশূন্য হতে চলেছে। সেদেশের সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে রাখাইন রোহিঙ্গাশূন্য করতে যাচ্ছে।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, রাখাইন রাজ্যের ২৫টি গ্রামে ‘রোহিঙ্গা মুসলিমমুক্ত’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে সেদেশের সেনাবাহিনী ও বিজিপি। রাখাইনের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের বসবাস।

কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। দেড় লাখের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে অবস্থিত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ৯০টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। বাকি দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।

ইউএনএইচসিআর, কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ও সেদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে যেভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে তাতে এক মাসের মধ্যেই রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে পড়বে রাখাইন।

সূত্র জানায়, ইউএনএইচসিআরের হিসাবে ২৫ আগস্টের পর পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু পালিয়ে আসা ও ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়াদের মতে, নির্যাতনের শিকার হয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। মিয়ানমারে স্থাপিত ইউএনএইচসিআরের ক্যাম্পে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।

রাখাইন থেকে পালিয়ে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া আবদুল মালেক জানান, সেনা ও ‘মগ’রা গ্রামে গ্রামে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা ও যৌন নির্যাতন চালায়।

জীবন বাঁচাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি পালিয়ে এসেছেন। এখন আত্মীয়স্বজনদেরও পালিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করছেন তিনি। কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া মংডু শিলখালীর হাজী আবদুল মোতালেব (৫৫) বলেন, মিয়ানমারে তার গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান ছিল।

সেখানে তার ২০ একর আবাদি জমি এবং দুই একর সুপারি বাগান ছিল। সেনারা তার দ্বিতল বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। দুই ভাই কালা মিয়া (৪০), মোজাহের মিয়া (৩০) ও ছেলে ইসলামকে (২০) গুলি করে হত্যা করেছে।

তিনি বলেন, একদিনে পাঁচ শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে সেনারা। জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে এক কাপড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, তাদের গ্রাম এখন রোহিঙ্গাশূন্য। শিলখালী, চাইন্দাপাড়া, লম্বা ঘোনাসহ পাশের গ্রামেও কোনো রোহিঙ্গা নেই।

কুতুপালং ক্যাম্পে মংডু তুলাতলীর খালেদ হোসেন (১৫) বলেন, তার মা-বাবাসহ চার বোনকে গুলি করে হত্যা করেছে সেনারা। আর যারা জীবিত ছিল তাদের তুলে নিয়ে যায়। মাঠে গরু চরাচ্ছিলাম বলে প্রাণে বেঁচে গেছি।

সেখান থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছি। খালেদ বলেন, চার দিন পর কুতুপালংয়ে তার ১১ বছর বয়সী ছোট বোন রিদুয়ানাকে খুঁজে পেয়েছি। সে অন্যদের সঙ্গে পালিয়ে এসেছে। ক্যাম্পে এক খালার সঙ্গে তারা বসবাস করছে।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, পশ্চিম রাখাইন, মংডু টাউনশিপ ও আকিয়াবের আশপাশ এলাকার রোহিঙ্গারা ভাবতে পারেননি তাদের ওপর নির্যাতন চালাবে সেনারা।

সেখানকার বাসিন্দারা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ও সচেতন। সেখানকার গ্রামবাসী চাঁদা তুলে কোটি কোটি টাকা সেনাবাহিনীকে দিয়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত রেখেছিলেন।

চট্টগ্রামের জহুর হকার মার্কেট থেকে পুরনো কাপড় আকিয়াবে নিয়ে বিক্রি করতেন এক রোহিঙ্গা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, যাতে তাদের দেশ ছাড়তে না হয় সেজন্য তারা সেনাবাহিনীকে ২ কোটি টাকা দেন।

২৫ আগস্ট নির্যাতন শুরু হলেও এতদিন অক্ষত ছিল তাদের এলাকা। কোনো সমস্যা হবে না বলে উল্টো সেনাবাহিনীই তাদের জানিয়ে দেয়। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে সেনারা তাদের গ্রামে হামলা ও বাড়িঘরে আগুন দেয়। সেখানকার রোহিঙ্গারাও দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সীমান্তে জড়ো হতে শুরু করেছে।

গুলিবিদ্ধ রাচিডংয়ের জোহরা বেগম (২০) বলেন, সেনা ও মগরা তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। জীবন বাঁচাতে বাড়ির বাঁশের বেড়া কেটে পালিয়ে আসার সময় হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছি।

একই সময় তার শ্বশুর মৌলভী নুরুল ইসলাম (৬০) দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে তারা পালিয়ে এসেছেন। এক সপ্তাহ আগে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

দুই দিন আগে বালুখালীতে আশ্রয় নেয়া বুচিডং নয়াপাড়ার শামসু (২৬) বলেন, সীমান্ত দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে এসেছি। যারা এখনও পালিয়ে আসতে পারেনি তাদের সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছে। তাদের হত্যা করা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন জোহরা।

রাখাইন রাজ্যের বুচিদং ও রাচিডং থানার ইয়াংমং, তিতারবিল, জাংগামা, মইদং, ছালিপাড়া, গোদামপাড়া, সাংগামা, জোপাড়া ও প্রিংডম গ্রামের রোহিঙ্গারা নাফ নদী দিয়ে মাত্র আধা ঘণ্টায় নৌকাযোগে বাংলাদেশে চলে আসছে। টেকনাফ সদর থেকে উখিয়ার বালুখালী পর্যন্ত নাফ নদীর এপারে উলুবনিয়া, জাদিমুরা আর ওপারে নাইচাপ্রাং ও কুমিরখালী। নাফ নদীর প্রস্থ মাত্র ৫০ থেকে ৬০ ফুট।

এটি ঘুমধুমে গিয়ে আরও ছোট হয়ে ২০ ফুটে দাঁড়িয়েছে। ভাটার সময় হাঁটুপানিতে অনেকেই হেঁটেই চলে আসেন। তবে বর্তমানে ওপারে জিরো পয়েন্টে দেড় সহস্রাধিক স্থলমাইন স্থাপন করায় সাগর পথকেই অনুপ্রবেশের জন্য বেছে নিয়েছে রোহিঙ্গারা।