আমাদের সময়:

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আসলে কার স্বার্থে কাজ করছে, এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত সাধারণ রোহিঙ্গারা। তারা কি রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে কাজ করছে, নাকি চলছে মিয়ানমার সরকারের ইশারায়। কারণ সংশয় সৃষ্টির মতো কার্যক্রমও চালাচ্ছে আরসা। তবে আরসা বিষয়ে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা খুবই অপ্রতুল বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, তাদের কার্যক্রম জানাচ্ছে আরসা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট একটি অংশ।
মিয়ানমারের রাখাইনে ২৪ আগস্ট রাতের হামলার আগে ‘আরসা’র নাম ছিল ফেইথ মুভমেন্ট। স্থানীয়ভাবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে হারাকাহ আল ইয়াকিন বা শুধু ইয়াকিন নামে পরিচিত। গত ২০ দিন কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, আরসা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়াই বেশি সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে।

২৪ আগস্ট রাখাইনে পুলিশের ২৪ তল্লাশিচৌকি ও একটি সেনাঘাঁটিতে আরসা হামলা চালায় বলে অভিযোগ করে মিয়ানমার সরকার। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনজুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু হয়। অভিযানের নামে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট চালানো হয়। ছোট্ট শিশুকেও ছুড়ে ফেলে, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। সেনাবাহিনীর দোসর মগরাও যুক্ত হয় নির্যাতন লুটপাটে। বাধ্য হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে থাকে।
সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আরসার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে দেখা যায় অনেককেই। তারা বলছেন, আরসার ভূমিকা নিয়েও এখন প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। কারণ আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের ওই সময়টাকেই কেন বেছে নিতে হলো হামলার জন্য। যে হামলার অভিযোগ তুলে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করছে মিয়ানমার সরকার। রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ এখন মনে করছেন, রোহিঙ্গা বিতাড়নের ক্ষেত্রে তৈরি করে দিয়েছে ‘আরসা’।
তবে আদৌ ২৪ আগস্ট রাতে হামলা চালিয়েছে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে বলেই মনে করেন তারা। নাকি এটি মিয়ানমার সরকারের একটি অজুহাত, তা খতিয়ে দেখার দাবি তুলেছেন রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ মনে করেন, আরসা তাদের অধিকার আদায়ে কাজ করছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আরসা’ নিয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সংগঠনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তারা যেভাবে বলছে আসলে সেই পরিমাণ জনবল বা অস্ত্র তাদের আছে বলে মনে হয় না। মিয়ানমার সরকার আরসা বিষয়ে কী ভাবছে সেটি আমাদের জানা নেই। তিনি আরও বলেন, আসলে ‘আরসা’ নিয়ে মন্তব্য করতে হলে অনেক তথ্য জানা প্রয়োজন। সেই কাজটি করতে পারে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
গত ৪ সেপ্টেম্বর উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে কথা হয় বৃদ্ধ আজগর আলীর সঙ্গে। আজগর আলী মোটামুটি পড়াশোনা জানা লোক। তার সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে জড়ো হন আরও কয়েক বৃদ্ধ রোহিঙ্গা। আজগর আলীর কথায় সায় দিলেন তারাও।
আজগর আলী বলেন, আরসাকে তারা ইয়াকিন নামে চেনেন। কিন্তু ইয়াকিনের খুব বেশি তৎপরতা রাখাইনে দেখেননি। ইয়াকিন আসলে কার স্বার্থে কাজ করছে সেটি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ না করলে তারা বিশ্বাসঘাতক।
যুদ্ধ ও সংঘর্ষ নিরসন ও প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী কাজ করা গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ আরসা নিয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও আরসার যোগসাজশে ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের ছেড়ে দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এমন তথ্য প্রকাশের পর অনেকেই মনে করেন, মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আরসার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
তবে মিয়ানমার সরকার বরাবরই আরসাকে ‘সন্ত্রাসীগোষ্ঠী’ আখ্যা দিয়ে আসছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনে হামলার জন্য এই সংগঠনকে দায়ী করা হয়। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনার বসতে আগ্রহী বলে এক টুইটবার্তায় জানায় আরসাÑ এমন খবর গত শনিবার আসে সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার আগে থেকেই বলে আসছে, সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার কোনো নীতি তাদের নেই। তাই কোনো আলোচনায় বসতে চায় না। এদিকে ৯ সেপ্টেম্বর শেষ হচ্ছে আরসার এক পাক্ষিক অস্ত্রবিরতির সময়। অস্ত্রবিরতির পর কী হবে সে বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলছে না সংগঠনটি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাখাইনে মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গণহত্যা চালানোর পরও কীভাবে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় আরসা সেটিও সন্দেহের জন্ম দেয়।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আরসার এক থেকে দেড় হাজার সদস্য রয়েছে বলে দাবি করা হলেও এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরসার অস্ত্রভা-ার নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারণ ২৪ আগস্ট রাতের হামলায় আরসা সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্রও ব্যবহার করে বলে জানায় মিয়ানমারের গণমাধ্যম। এর থেকে অনেকেই মনে করছেন, আরসার অস্ত্রভা-ার যা বলা হচ্ছে ততটা নয়। আরসা সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে নিজেদের যেভাবে জাহির করছে বাস্তবে তাদের সক্ষমতা অতটা নয়।
আরসার বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্ব রয়েছে বিদেশে বড় হওয়া রোহিঙ্গাদের হাতে। আরসা প্রধান আতাউল্লাহর জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে। বেড়ে ওঠা ও পড়ালেখা করেছেন সৌদি আরবে। ২০১২ সালে তিনি সৌদি আরব থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান।
তবে ইন্টারনেটে প্রকাশ করা ভিডিওবার্তায় আরসা দাবি করেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে তারা। ‘আত্মরক্ষামূলক’ হামলার মূল টার্গেট হচ্ছে মিয়ানমারের ‘নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী।’ তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত নয়। অধিকার আদায়ের জন্যও তারা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী নয় বলে দাবি আরসার।