বিদেশ ডেস্ক:

৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে মার্কিন সেনাবাহিনী। ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি না দেওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন তারা। ট্রাম্পের দাবি সেনাবাহিনী তার সঙ্গে আছে। একই দাবি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনেরও। অবশ্য সেনাবাহিনী বলছে, নির্বাচনে তাদের কোনও ভূমিকা নেই। তবে ট্রাম্প বলেছেন, নির্বাচনের ফলকে তিনি জালিয়াতিপূর্ণ মনে করলেই ২০০ বছরের পুরনো আইন ব্যবহার করে সেনাবাহিনী নামাবেন। এমন বাস্তবতায় রাজনীতিকে একপাশে সরিয়ে রেখে এ বছর পেন্টাগনের পরিকল্পনাকারীদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনতে পারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থীর স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট বিজয়; তা ডোনাল্ড ট্রাম্পই জিতুন কিংবা জো বাইডেন।

আগামী মঙ্গলবারের নির্বাচনের আগের কয়েক মাসে থেকেই মার্কিন সেনা কর্মকর্তারা নির্বাচনকে ঘিরে সম্ভাব্য বিভাজনের কথা আমলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। গত জুনের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের মতো পরিস্থিতির কথাও মনে করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণতা নির্বাচন হলে আমেরিকার শীর্ষ জেনারেলরা আইনপ্রণেতাদের আশ্বস্ত করতে পারবেন যে, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেনের মধ্যকার নির্বাচনি বিরোধে তাদের কোনও ভূমিকা নেই। সিদ্ধান্তমূলক ফলাফল দীর্ঘ মেয়াদী রাজনৈতিক সংকট এবং এ থেকে সৃষ্ট সম্ভাব্য বিক্ষোভের আশঙ্কা কমিয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরাও একই মত পোষণ করছেন।

সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজের বিপুল সমর্থনের দাবি করা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন আগামী মঙ্গলবারের নির্বাচনকে তিনি যদি জালিয়াতিপূর্ণ হয় আর তার জয়ের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয় তাহলে দুইশ’ বছরের পুরনো বিদ্রোহ আইন ব্যবহার করে সেনা মোতায়েন করবেন তিনি। সেপ্টেম্বরে ফক্স নিউজকে ট্রাম্প বলেন, ‘দেখুন এটাকে বিদ্রোহ বলে। আমরা কেবল তাদের ভেতরে পুরবো আর এটা করা খুবই সহজ।’ অন্যদিকে বাইডেন বলেছেন, নির্বাচনের পর ট্রাম্প যদি ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান তাহলে সেনাবাহিনী শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করবে।

এমন প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘আমাদের (সেনাবাহিনীর) জন্য সবচেয়ে ভালো বিষয় হবে যে কোনও একজনের বড় বিজয়।’ সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করে মারকুয়েত্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিসা ব্রুকস বলেন , এতে সামরিক বাহিনী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।

নির্বাচনের আগে রয়টার্স/ইপসসের এক জনমত জরিপে দেখা গেছে দেশজুড়ে ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় দশ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন বাইডেন। তবে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে ব্যবধান খুবই সামান্য। আর এসব রাজ্যের ফলাফলই চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করবে। ২০১৬ সালে এসব রাজ্যগুলোতে নিজের বিস্ময়কর জয় পান ট্রাম্প। তবে এই বছরের করোনাভাইরাস মহামারি এক ধরণের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে যে কখন ও কিভাবে মার্কিন নাগরিকেরা ভোট দেবে। জনমত জরিপ অনুযায়ী কংগ্রেস, প্রেসিডেন্ট কিংবা সুপ্রিম কোর্টের চেয়েও আমেরিকার সবচেয়ে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনী। কিন্তু এই বছর মহামারি, সামাজিক অস্থিরতা এবং দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরই নিজেদের প্রতি সমর্থন থাকার দাবি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছে সেনাবাহিনী।

মার্কিন সেনাবাহিনীর জেনারেল মার্ক মিলেকে গত বছর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ হিসেবে মনোনীত করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি মনে করেন, ব্যালটের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারিত হলে এইসব বিরোধের বাইরে থাকবে সেনাবাহিনী। এ মাসে ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওকে তিনি বলেন, ‘যদি কোনও বিরোধ হয়, তাহলে সেগুলো যথাযথভাবে সামাল দেবে আদালত এবং মার্কিন কংগ্রেস। মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে সেনাবাহিনীর কোনও ভূমিকা নেই, একেবারেই শুন্য। কোনও ভূমিকাই নেই।’

দায়িত্ব পালনের পুরো সময় নিয়মিতভাবে সেনাবাহিনীর মুখাপেক্ষী হয়েছেন ট্রাম্প। দক্ষিণাঞ্চলী মেক্সিকো সীমান্ত রক্ষায় সহায়তা চাওয়া ছাড়াও করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ভ্যাকসিন বিতরণের কাজে একজন সেনা জেনারেলকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলে রেখেছেন তিনি। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ পিটার ফেভার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন সংকটের সময় আমেরিকানদের সেনাবাহিনীর মুখাপেক্ষী হতে চাওয়ার প্রবণতা নাগরিকদের আশাবাদী করে তুলতে পারে যে নির্বাচন নিয়ে সংকটের সমাধানেও তারা এগিয়ে আসবে, যদিও এটা ভুল ধারণা। তিনি বলেন, ‘নভেম্বরের ৩০ তারিখ পর্যন্তও যদি সবকিছু ঠিকঠাক না চলে আর তখনও যদি প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন তা নিয়ে কোনও ধারণাই না করা যায় তাহলেই সেনাবাহিনীর ওপর চাপ বাড়তে থাকবে।’ তার ধারণা ওই সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে রাজপথে বিক্ষোভ বাড়তে শুরু করবে।

সব আশঙ্কার কেন্দ্রের রয়েছে এমন ধারণা যে ট্রাম্প সম্ভবত বিক্ষোভ দমন করতে সেনা সদস্য মোতায়েন করতে পারেন। ১৮০৭ সালের বিদ্রোহ আইন সক্রিয় করলে খুব সহজেই বৈধ উপায়ে সেনা মোতায়েনের পথে হাঁটতে পারবেন ট্রাম্প। বাইডেনকে সমর্থন দেওয়া নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল স্টিভ অ্যাবোট বলেন, বিপদ হলো ট্রাম্প বিদ্রোহ আইন প্রয়োগ করতে পারেন। আর তাহলে পেন্টাগনে যারা দায়িত্বরত রয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে উদ্বেগে পড়বে। বাইডেনকে সমর্থন করা জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের একটি শীর্ষ গ্রুপের নেতৃত্ব দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল মাইক স্মিথ বলেন, তার উদ্বেগ হলো নির্বাচন পরবর্তী সংকটে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনে ট্রাম্প খুব সহজেই সেনাবাহিনীর মুখাপেক্ষী হতে পারেন। স্মিথ বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে অপব্যবহার করার বিপুল আশঙ্কা রয়েছে।’

বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের ন্যাশনাল গার্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হলে কী করার দরকার পড়বে তা নিয়ে তারা নিয়মিতভাবেই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তবে এসব কর্মকর্তারা বলেছেন, এই ধরনের পরিকল্পনা সেনাবাহিনী করে থাকে। টেনেসি ন্যাশনাল গার্ডের অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল এবং সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জেফ হোমস বলেন, আমরা বেশ কিছু বৈঠক করেছি, এর কারণ কেবল যেন আমাদের হাতে করার মতো একাধিক বিকল্প উপায় থাকে। নেব্রাস্কা ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান বিমান বাহিনীর মেজর জেনারেল ড্যারিয়েল বোহাক অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, এটা নতুন কিছু নয়, বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন বছরেই আমাদের এটা করতে হয়।’